বিশ্বের বৃহত্তম দেওয়াল ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা, পাঁচ দশক পেরিয়েও উজ্জ্বল ‘অজন্তা’

১৯৭১ সাল। মাত্র ১ লক্ষ টাকার পুঁজি নিয়েই ঘড়ি তৈরির কারখানা তৈরি করেছিলেন গুজরাটের তিন বিনিয়োগপতি। তবে কারখানা তৈরির উদ্যোগ নিলেও ঘড়ির প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না তাঁরা কেউই। ফলে দ্বারস্থ হওয়া গুজরাটেরই মরবি অঞ্চলের এক বিজ্ঞান শিক্ষকের কাছে। প্রস্তাব রাখা হল, কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই তাঁকে অংশীদার করা হবে এই ব্যবসার। বদলে প্রযুক্তিগত দিকগুলির দায়িত্ব সামলাতে তবে তাঁকে। না, ফেরাননি তিনি। বরং, গবেষণা এবং প্রযুক্তিচর্চার জন্য ছেড়েছিলেন শিক্ষকতা। 

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে এভাবেই পথ চলা শুরু হয়েছিল ‘অজন্তা’ ঘড়ি কারখানার। সেদিনের সেই কারখানাই আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেওয়াল ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা। আর তাঁর পিছনে অবদান সেই বিজ্ঞান শিক্ষকের। ওধবজী রাঘবজী প্যাটেল। সংক্ষেপে ও.আর. প্যাটেল। পরিচিত ঠেকছে নামটা? লাগারই কথা। কারণ, জীবদ্দশায় ‘অরপ্যাট’-এর কোনো সামগ্রী ব্যবহার করেননি এমন মানুষ এই ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। এই ব্র্যান্ডের নামকরণ তাঁরই নামে। যদিও অনেক পরে তৈরি হয়েছিল অজন্তার এই বিশেষ বিভাগ। 

তবে লাভের থেকেও এই ব্যবসায় জড়ানোর অন্য একটি লক্ষ্য ছিল রাঘবজীর। তা হল দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা। তাঁর সেই উদ্দেশ্য যে একশো ভাগ সফল— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে কম লড়াই করতে হয়নি তাঁকে। কারখানা প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছর শুধুই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল অজন্তাকে। আর সেখান থেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন তিন বিনিয়োগকারীই। শুধু পিছিয়ে আসেননি রাঘবজী। নিজের অংশীদারি ভাঙিয়েই বেতন দিয়ে গেছেন কারখানার কর্মীদের। ব্যবসা না চললেও বিনা পয়সায় কাজ করতে হয়নি কাউকে। শেষ অবধি তাঁর সততা এবং পণ্যের গুণগত মানই ভাগ্য বদলে দেয় অজন্তার।

তবে এসবের মধ্যে থেমে থাকেনি উদ্ভাবনীর অনুসন্ধান। বছর দশেক পর জাপানে পাড়ি দিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, সেখান থেকে শিখে আসা কোয়ার্জ পদ্ধতিতে ঘড়ি নির্মাণের প্রক্রিয়া। হলও তেমনটাই। ১৯৮৫ সালে ভারতে সর্বপ্রথম কোয়ার্জ ঘড়ি তৈরি হল তাঁর হাত ধরেই। সাশ্রয়ী এই ঘড়িই বদলে দিল গোটা ভারতের বাজারকে। 

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় হিসাবে কমিক জগতের ‘অস্কার’জয়ী আনন্দ

অজন্তার শাখা সংস্থা ‘অরপ্যাট’-এর জন্ম এরও বছর পাঁচেক পর। ১৯৯১ সালে। সেখানেও ব্যবহৃত হল কোয়ার্জ ক্রিস্টাল। অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতের বৃহত্তম ক্যালকুলেটার প্রস্তুতকারক হয়ে উঠল অরপ্যাট। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বৈদ্যুতিন যন্ত্র, রান্নার সরঞ্জাম, জুতো, পোশাক-সহ ব্যবসার একাধিক ক্ষেত্রতেই বর্তমান রাজত্ব করছে এই সংস্থা। বছরে প্রায় ১২৫০ কোটি টাকার টার্নওভার। ভারতের বাইরে ৪৫টি দেশে রপ্তানি হয় অজন্তার ঘড়ি। 

আরও পড়ুন
শুরুতেই শনাক্ত হবে কোলন ক্যানসার, যুগান্তকারী আবিষ্কার ভারতীয় গবেষকদের

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই ব্যবসার মধ্য দিয়েই একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ওধবজী। তাঁর হাত ধরেই গুজরাটে শুরু হয়েছিল মহিলা ক্ষমতায়ন। আর অজন্তার প্রথম মহিলাকর্মী ছিলেন স্বয়ং রাঘবজীর স্ত্রী ভানিতাবেন। অরপ্যাট প্রতিষ্ঠার পর রাঘবজী এবং তাঁর স্ত্রী মহিলা ক্ষমতায়নের কথা প্রচার করেছিলেন বাড়িতে বাড়িতে গিয়েই। কারখানায় কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন গৃহবধূ এবং শিক্ষিত তরুণীদের। আজও অরপ্যাটে বজায় রয়েছে সেই ধারা। সংস্থার সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মীদের মধ্যে পাঁচ হাজারই মহিলা। অর্থাৎ, প্রায় ৯৬ শতাংশই মহিলাকর্মী। 

আরও পড়ুন
অলিম্পিকে মশাল রিলের ভারতীয় প্রতিনিধি আজ চা-বাগানের কুলি

এখানেই শেষ নয়। প্রতি কর্মচারীর নিয়মিত মেডিক্যাল চেক-আপ এবং মাসিক রেশন এবং ইংরাজি ভাষার শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। চার দশক পেরিয়ে এসে আজও অব্যাহত রয়েছে সেই ধারা। সময় বদলেছে। সংস্থার মালিকানা এখন সন্তানদের হাতে। শুধু রয়ে গেছে সেই ঐতিহ্য। 

প্রযুক্তির দৌলতে আজকের দিনে ঘড়ির চাহিদা কমেছে অনেকটাই। সময় দেখার ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি এখন মোবাইল আর স্মার্ট ওয়াচই। তবে সময়ের চাকা গড়ালেও, ডিজিটাল ঘড়ি তৈরির দিকে ঝোঁকেনি রাঘবজীর প্রতিষ্ঠিত অজন্তা। বরং, প্রথাগত ঘড়িকেই আঁকড়ে রয়েছে এই সংস্থা। তার পরেও যে তাঁদের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি, তা বলাই বাহুল্য…

Powered by Froala Editor