অলিম্পিকে মশাল রিলের ভারতীয় প্রতিনিধি আজ চা-বাগানের কুলি

মাত্র ৯ বছর আগের কথা। লন্ডনের নটিংহামশায়ার রোডের উপর দিয়ে সেদিন মশাল হাতে ছুটেছিলেন এক ভারতীয় কিশোরী। অলিম্পিকের মশাল হাতে। পিঙ্কি কর্মকার। সারা বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাছাই করা প্রতিনিধিদের মধ্যে মাত্র একজন ভারতীয়। সেদিন পিঙ্কি হয়ে উঠেছিলেন গোটা দেশের গর্ব। প্রতিটা সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছিল মশাল হাতে পিঙ্কির ছবি। তারপর? ৯ বছর বাদে পিঙ্কির আর খোঁজ রাখে না দেশ। তার খেলাধুলোর স্বপ্নও পূরণ হয়নি। আজ পিঙ্কি আসামের একটি চা বাগানে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।

২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক। ভারত সে বছর ৬টি পদক পেয়েছিল। তখনও অবধি সেটাই সর্বোচ্চ। ফলে ভারতবাসীর মধ্যে একটা আলাদা উন্মাদনা তো ছিলই। সেইসঙ্গে অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্র ছিলেন পিঙ্কি। লন্ডন থেকে ফিরে বিমানবন্দরে পা দেওয়ামাত্র তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ডিব্রুগড়ের তৎকালিন সাংসদ সর্বানন্দ সোনওয়াল। রাজ্য থেকে কেন্দ্র স্তরের সমস্ত নেতা-মন্ত্রীরা বলেছিলেন, পিঙ্কি তাঁদের গর্ব। আর পিঙ্কি জানিয়েছিলেন তিনি অলিম্পিকের মাঠে নামতে চান একজন তীরন্দাজ হয়ে। এরপর অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। লন্ডন অলিম্পিকের রেকর্ডকে পিছনে ফেলে টোকিও অলিম্পিকে এখনও পর্যন্ত ভারতের প্রাপ্ত মেডেল ৭টি। আর সেদিনের ডিব্রুগড়ের সাংসদ সর্বানন্দ পরবর্তীকালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় রয়েছেন। কিন্তু পিঙ্কির তীরন্দাজ হওয়া হয়ে ওঠেনি। জীবনসংগ্রামে পাশে পাননি একজনকেও।

ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোর প্রতি ভালোবাসা ছিল পিঙ্কির। আর ইউনেস্কোর স্পোর্টস ফর ডেভালাপমেন্ট প্রকল্পের সুবাদে নিজেকে মেলে ধরার জায়গাও পেয়েছিলেন। নিজের অনুশীলনের পাশাপাশি আসামের চা-বাগান এলাকায় খেলাধুলোর বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করতেন পিঙ্কি। স্কুলজীবন থেকেই এলাকার বহু কচিকাঁচাকে ট্রেনিং দিতেন তিনি। আর সকালে নিজের পড়াশোনা সামলে রাতে চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য খুলে বসতেন নিজের নৈশবিদ্যালয়। সেই সবই আজ অতীত। কলেজে পড়ার সময়েই হঠাৎ অসুস্থতায় মারা গেলেন পিঙ্কির মা। বাবাও তখন বয়সের কারণে কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। সংসারে আরও দুই বোন এবং এক ভাই। সকলের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে হবে পিঙ্কিকেই। তবুও খেলার স্বপ্ন ছাড়তে চাননি পিঙ্কি। বারবার ছুটেছেন সরকারি কর্তাদের কাছে। ইউনেস্কোর কাছেও চিঠি লিখেছেন একাধিকবার। কিন্তু লাইমলাইটের আলো যে ততদিনে তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে।

না, কোথাও কোনো সাহায্য পাননি পিঙ্কি। শেষে নিরুপায় হয়ে যোগ দিয়েছেন মায়ের পেশাতেই। এখন ২৬ বছরের তরুণী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগানে চায়ের পাতা তোলেন। খেলাধুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বন্ধ নৈশবিদ্যালয়। হতাশ পিঙ্কি শুধু প্রশ্ন করেন, কী হবে এতকিছু করে? চা-বাগানের কুলির মেয়েকে তো শেষ পর্যন্ত চা-বাগানের কুলিই হতে হবে। অথচ একটু সাহায্য পেলেই হয়তো নিজেকে প্রমাণ করতে পারতেন পিঙ্কি। আর তাঁর হাত ধরে এগিয়ে আসতে পারত ডিব্রুগড়ের চা-বাগান অঞ্চলের একটা গোটা সমাজ। সবই হতে পারতো, কিন্তু কিছুই হয়নি। কারণ অলিম্পিকের আয়োজন মিটতে না মিটতেই পিঙ্কিকে ভুলে গিয়েছেন সবাই। এভাবেই ঝরে যায় মরশুমি ফুলেরা।

আরও পড়ুন
রেকর্ড সময়ে ম্যারাথন-জয়, শেষ দিনেও বিস্ময়ের সাক্ষী অলিম্পিক

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চতুর্থ স্থানের ‘ফাঁড়া’— একটুর জন্য অলিম্পিকে পদক পাননি যেসব ভারতীয়