আদালতের আইনি নথিতে কমিকস, চমকে উঠলেন স্বয়ং বিচারপতি!

দুটি বৈশ্বিক বিপণন সংস্থা এবং খ্যাতনামা বেশ কয়েকটি প্রকাশকের মধ্যে মামলা চলছে। স্বাভাবিকভাবেই থমথমে আদালত চত্বর। এক পক্ষের আইনজীবী উঠে গিয়ে বিচারকের কাছে পেশ করলেন মোটা ফাইল। তাতেই লেখা রয়েছে তাঁর যাবতীয় বক্তব্য, অন্যান্য প্রামাণ্য নথি। এবার দ্বিতীয়পক্ষের পালা। তবে তাঁর পেশ করা নথি হাতে নিয়ে রীতিমতো চমকে উঠলেন স্বয়ং বিচারক। তাঁর জমা দেওয়া নথির আয়তন মাত্র পাঁচ পাতা! না, বিস্তারিত কোনো বর্ণনা বা বক্তব্য নয়, এই নথি জুড়ে আঁকা হয়েছে বেশ কিছু ছবি। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে কমিকস (Comics)।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এমনই এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA) তথা গোটা বিশ্ব। নেপথ্যে লস অ্যাঞ্জেলিসের আইনজীবী বব কন (Bob Kohn)। দীর্ঘ বিরক্তিকর বর্ণনার জন্য কুখ্যাতি রয়েছে আদালতের নথিপত্রের। আর এই একঘেয়েমি কাটাতেই শেষ পর্যন্ত কমিকসের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর এই আশ্চর্য উদ্যোগের পিছনে ছিল আরও একটি কারণ। সে-কথায় না হয় পরে আসা যাবে, আপাতত শুরু থেকেই বলা যাক এই কাহিনি। 

আসলে এই মামলার নেপথ্যে রয়েছে কমিকসই। টেক জায়েন্ট অ্যাপেল এবং অনলাইন বিপণন সংস্থা আমাজনের বিরুদ্ধে এই মামলা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ৫টি কমিকস পাবলিশিং হাউস। অভিযোগ, মাত্র ১০ ডলারের বিনিময়েই তারা কমিকসের ই-বুক বিক্রি করছে অনলাইনে। যা কিনা ছাপা কমিকস বই-এর উৎপাদন মূল্যের প্রায় অর্ধেক। আর আমাজন ও অ্যাপেলের এই পদক্ষেপে রীতিমতো বন্ধ হতে বসেছে তাদের ছাপা বই-এর ব্যবসা। কারণ, কম দামে ই-বুক পাওয়ায়, অধিকাংশ গ্রাহকই ঝুঁকছেন সেদিকেই। একাধিকবার আমাজন ও অ্যাপেলকে বিক্রয় মূল্য বাড়াতে বলা হলেও, সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি তারা। পাশাপাশি অবৈধ ডাউনলোডের সম্ভাবনাও রয়ে যাচ্ছে তাতে। এমন চলতে থাকলে, একটা সময় নতুন কমিকস তৈরিই বন্ধ হতে বসবে, এমনই দাবি করেছিলেন প্রকাশকরা। 

উল্লেখ্য, পাঁচ মার্কিন প্রকাশকের হয়ে এই মামলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আইনজীবী বব কন। প্রাথমিকভাবে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মামলার মতো করেই তাঁর বক্তব্য নথিভুক্ত করেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে তাঁর তৈরি সেই নথির আকার দাঁড়িয়েছিল ৫৫ পাতা। বিপক্ষকে জব্দ করতে, সবমিলিয়ে ১২টি বিষয়ে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। 

তবে এই পরিকল্পনা বদলে যায় তাঁর কন্যা কেটির হস্তক্ষেপে। কেটি তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে। তবে চিরকালই তাঁকে সিনেমার থেকেও বেশি আকর্ষণ করেছে কমিকস। ফলে, এমন একটা মামলা নিয়ে তাঁর কৌতূহল ছিলই। আর সেই আগ্রহের বশেই বাবার কাছে মামলার খবর জানতে এসেছিলেন তিনি। তবে বাবার তৈরি করা নথি দেখে রীতিমতো মুষড়ে পড়েন কেটি। খানিক হতাশ হয়েই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই দুর্বোধ্য ফাইল কি আদৌ পড়ে দেখবেন বিচারপতি? 

সরল মনে করে মেয়ের এই প্রশ্নই দাগ কেটেছিল ববের চিন্তাভাবনায়। সত্যিই তো। গল্পের ছলে কি এই কঠিন বিষয়টিকে উপস্থাপন করা যায় না? আর মামলার বিষয় যখন কমিকস, তখন এসব ভারি ভারি শব্দ সাজিয়ে বিচারকের কাছে নিজের বক্তব্য পেশ করার আদৌ মানে আছে কোনো? শেষ পর্যন্ত বব শরণাপন্ন হন কমিকসের কাছেই। কমিকস স্ট্রিপের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলেন নিজের বক্তব্য।

এই কমিক স্ট্রিপে মূলত তুলে ধরা হয়েছে দুটি চরিত্রের মধ্যে চলা বিতর্ককে। সেখানে একপক্ষ ই-বুকের দাম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সওয়াল হয়েছে,আর অন্যজনের মুখে ই-বুকের মাত্রাতিরিক্ত কম দামের কারণে ছাপা বই-এর বাজার নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। অবশ্য এই কমিক স্ট্রিপকে নিছক বিনোদন ভাবলে ভুল হবে। ৫৫ পাতার নথিতে যে আইনি বিষয়গুলি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, প্রতিটি আঙ্গিকই কোনো না কোনোভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল ৫ পাতার কমিকসটিতে। অবশ্য এক্ষেত্রে কৃতিত্ব তাঁর একার নয়। বব এই দুই চরিত্রের কথোপকথন ও বক্তব্য লিখলেও, কমিকসটি এঁকেছিলেন তাঁরই কন্যার এক সহপাঠী। 

তবে দুঃখের বিষয় হল, বব কনের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সাধারণ মানুষ এবং প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, শেষ পর্যন্ত মামলা-জয় অধরাই থেকে যায় তাঁর। তবে তাতে বিন্দুমাত্র নিরাশ হয়নি প্রকাশকরা। বরং, ববের জমা দেওয়া এই নথির সমর্থনে সরব হয়েছিলেন তাঁরা। জানিয়েছিলেন এই উদ্যোগ আসলে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। বাস্তব ক্ষেত্রে ববের এই ‘আইনি কমিকস’ সাধারণ মানুষকে মুদ্রিত বই-এর প্রতি আকর্ষিত করুক কি না-করুক, আইনের জগতে যে এক অনন্য মাইলস্টোন তৈরি করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor