এক আশ্চর্য অগ্নিকুণ্ড, যার মধ্যে দিয়ে হেঁটে নিখাদ হল ভারতীয় ক্রিকেট

ঋষভ পন্থের ব্যাট ছুঁয়ে যখন লালচেরি বলখানা বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়ে ফেলল, তখন ভারত কি স্রেফ একটা টেস্ট ম্যাচ জিতল? নাকি অজেয় অজিদুর্গের দেওয়ালে খোদাই করে দিল একটা প্রবাদ - 'টেস্ট ম্যাচ আসলে লড়াই কলজের, মানসিকতার, রেকর্ড-স্ট্যাট সেখানে তুচ্ছ...'

হোসে মোরিনহোর সাক্ষাৎকারগুলো যাঁরা নিয়মিত ফলো করেন তাঁরা জানেন, তিনি একটা কথা বলেন যে আমার খেলাটা শুরু হয় ম্যাচের আগেরদিনের প্রেস কনফারেন্স থেকে। খেলাটাকে দুভাগে ভেঙে দিই আমি, একটা টেকনিকাল গেম, একটা মেন্টাল গেম। লড়াই-এর ময়দানে নামার আগে মেন্টাল গেমটাই খেলার রং পালটে দেয়। মানসিকতা, ইন্টেন্ট ফুটে বেরোয় মাঠের সবুজে পা রাখা খেলোয়াড়দের চেহারা থেকে। আদর করে আমরা যাকে বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বলে ডাকি। ডিসেম্বরের পাতাঝরা মরশুমে কদিন আগেই ৩৬ রানে গুঁড়িয়ে যাওয়া, দলের একনম্বর তারকা ও অধিনায়কের দেশে ফেরা, অন্যতম পেস অস্ত্রের আঙুল ভেঙে বসে যাওয়া, দুটো বাচ্চা ছেলেকে ডেবিউ করানো - সবকিছুর ভেতর থেকে লালছোপ লাগা ব্যাটটা ধরে ঠায় ক্রিজে দাঁড়িয়েছিলেন অজিঙ্ক রাহানে। খেলাটা ভদ্রলোক শুরু করেছিলেন এম সি জি ড্রেসিংরুম থেকে। আর লড়াইটা শেষ হল ঋষভ পন্থের ব্যাটে।

একটু স্ট্যাটিস্টিক্সে চোখ রাখা যাক। ব্রিসবেন-গাব্বা আসলে অজিসাম্রাজ্যের সবথেকে কঠিন দুর্গ। গাব্বার পিচের যে অস্বাভাবিক গতি ও বাউন্স তা যদি প্রথম কারণ হয় তবে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই তার অস্বাভাবিক আচরণ। চতুর্থ দিনের পর থেকেই পিচ ফাটে এবং বলের অসমান বাউন্স আর অচেনা টার্নে নাজেহাল হয় প্রতিপক্ষ। এই চক্রব্যুহ যে ভারতকেও পেরোতে হয়েছে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। কিন্তু যে পিচে চতুর্থ ইনিংসে শেষবার ১৯৫১ সালে ২৩৬ রান তাড়া করে জিতে রেকর্ড হয়েছিল, সেই সাহারায় শিহরণ জাগিয়ে একটা ভাঙাচোরা দল কীভাবে তাড়া করল ৩২৮ রান? কীভাবে ৩২ বছর পর প্রথম অজিসাম্রাজ্যের ভিত টলে গেল গাব্বায়? ম্যাজিকের চেয়েও জরুরি হল ক্রিকেটিয় বেসিকে ফিরে যাওয়া। রবি শাস্ত্রী একবার বলেছিলেন খেলা থেকে পিচকে বাদ দাও, অর্থাৎ পিচের আচরণ আমাদের হাতে নেই তাই তার ভয়কে মস্তিষ্ক থেকে সাফ করে মন দাও টেকনিকে, মন দাও নিজেদের খেলায়। এম সি জি-র টার্নিং উইকেটে যে লড়াইটা দ্বিতীয় টেস্টে ভারত করে সিরিজে সমতা ফেরাল, তা যেন অনেকটা এভাবেই। সমীক্ষা বলছে এক দুটো ইনিংস বাদে এই সিরিজে প্রায় প্রতি ইনিংসেই ৯০ ওভার ব্যাট করেছে ভারত, এত লম্বা সময় ধারাবাহিকভাবে বিগত কুড়ি-তিরিশ বছরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোনো দেশ সেভাবে করতে পারেনি। 

এর পিছনে একটা খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার পৌঁছোনোর গল্পও রয়েছে। আইপিএল যতই টেস্টপ্রেমীদের চক্ষুশূল হোক, ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের এই যে কঠিন মানসিকতা গড়ে ওঠা এর পিছনে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টকে অস্বীকার করা যায় না, খেলার গতিকে কমাতে-বাড়াতে রানিং বিটুইন দ্যা উইকেটের গুরুত্ব কিংবা গ্যাপে প্লেস করে রান বের করে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার যে ধারাবাহিক অনুশীলন তা অনেকটাই গড়ে ওঠে বিশ্বের নানা প্রান্তে আইপিএলের মতো জনপ্রিয় শর্ট ফর্ম্যাট ক্রিকেট লিগগুলোতে৷ খেয়াল করলে দেখা যাবে এই ভারত, তারুণ্যের ভারতকে আগলে রেখেছে পূজারা-রাহানের বিশ্বস্ত ব্যাট। পূজারার নিশ্চিদ্র প্রহরায় নিজেদের মেলে দিলেন একের পর এক তরুণ, বড়ো রান শেষ দিনে তাড়া করার জন্য ভারতের যে গেমপ্ল্যান, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত সর্বত্র। এই যে ক্লাসিক টেস্ট ব্যাট ও আগ্রাসী তারুণ্যের মেলবন্ধন এটাই ভেঙে দিল কালাপাহাড়। ভারত রানের গতি বাড়াল একেবারে অঙ্ক কষে, প্রথম সেশনে ৭৮, দ্বিতীয় সেশনে ১০৫, তৃতীয় সেশনে ১৪৫। অঙ্কটা অনেকটা সরলরৈখিক, উইকেট হাতে রেখে শেষ ১০ ওভার অবধি পৌঁছনো, বাকিটা জানা আছে সব্বার।

আরও পড়ুন
চোট-আঘাতে জর্জরিত, তবু অদম্য লড়াই : ক্রিকেট মাঠে ভারতের মহাকাব্য

এ তো গেল স্ট্রাটেজি। আর মানসিকতা? আসলে মেলবোর্নে রাহানের সেঞ্চুরি, জাডেজার লড়াই, সিডনীতে হনুমা-অশ্বিন নাছোড় যুদ্ধ, গাব্বার প্রথম ইনিংসে সুন্দর-শার্দুল আর সিরাজের অদম্য জেদ যেন শেষদিনের মানসিকতার অর্কেস্ট্রাকে বেঁধে দিয়েছিল সুর-তাল-লয়ে। বাকিটা এনিগমা, আশ্চর্য এনিগমা!

জাস্টিন ল্যাঙ্গার গোঁড়া অজি কোচ, ম্যাচের পর বলতে বাধ্য হলেন - "Never ever underestimate the Indians" - স্কোরবোর্ডের ও অনেক ওপরে ভারতের জিতে যাওয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শীলমোহর হয়ত এটাই...

আরও পড়ুন
প্রথম মহিলা হিসেবে টেস্টে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ক্লেয়ার, ইতিহাসের সাক্ষী ভারত-অস্ট্রেলিয়া

বিরাট কোহলির রঙিন পৃথিবী, পূজারার সাদাকালো যাপনের দুটো ভিন্ন মেরুর মাঝখানে অজিঙ্ক রাহানে একেবারে পথচলতি বহমানতা, রাজপথ কিংবা লালমাটি নয় - আমআদমির মতো মফঃস্বলের রাস্তাদিয়ে বাস্তবের খুচরো হাতে খেলাটা শুরু করেছিলেন অ্যাক্সিডেন্টাল ক্যাপ্টেন। কামিন্সের প্রতিটা বলের পর তির্যক চাউনি, ত্রিশঙ্কু আক্রমণের চেনা অজি আগ্রাসন কিংবা উত্তপ্ত গ্যালারির সামনে বরফের মতো শান্ত একটা লোক যেন আগলে রাখলেন দলকে - "আমি ক্রিকেট খেলতে এসেছি, মন দিয়ে ক্রিকেটটাই খেলব, আর কিচ্ছু না..." - সেই পা বাড়িয়ে জমাট ডিফেন্সটাই আসলে মানসিকতা হয়ে গেল একটা দলের। সেখান থেকে জেতা আর হারা দুটো গন্তব্য ছিল মাত্র – স্থির গন্তব্য, কিন্তু ভারতের কাছে এই সিরিজ একটা যাত্রাপথ, এক আশ্চর্য অগ্নিকুণ্ড যার ভেতর দিয়ে মাইলের পর মেইল হেঁটে নিখাদ হল ভারতীয় ক্রিকেট...

Powered by Froala Editor