দারিদ্র‍কে হারিয়ে রাগবির ময়দানে বাংলার তরুণীরা

কারোর খাবার জোটে না দু’বেলা। কেউ জল-মুড়ি খেয়েই নেমে পড়েন অনুশীলনে। আবার অর্থের অভাবে কাউকে পঠনপাঠন ছেড়ে অল্পবয়সেই নাম লেখাতে হয়েছে শ্রমের খাতায়। না, কোনো ভিনরাজ্যের কথা নয়। এই দৃশ্যপট পশ্চিমবঙ্গেরই জলপাইগুড়ি জেলার। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই জলবাইগুড়ির (Jalpaiguri) উপজাতি সম্প্রদায়ের তরুণীরা আজ ফুল ফোটাচ্ছেন ভারতের জাতীয় দলে। 

নিশ্চয়ই ভাবছেন, ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা হকির কথা। কিন্তু এর বাইরেও একটা বিস্তীর্ণ ক্রীড়াক্ষেত্র রয়েছে— তার সম্পর্কে ক’জনই বা খবর রাখি আমরা? কথা হচ্ছে, রাগবি (Rugby) নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাস-সহ দুই আমেরিকার দেশগুলি তো বটেই, ইউরোপেও বেশ জনপ্রিয় এই খেলা। অথচ, সেই নিরিখে আজও অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছেই ‘অপরিচিত’ থেকে গেছে রাগবি। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। রাগবির পরিকাঠামো তৈরিতে কতটাই বা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার? তার কতটুকু প্রচারই বা করে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলি? 

১৯৯৮ সালের কথা। ভারতে প্রথম স্থাপিত হয়েছিল রাগবি ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ তারও বছর তিনেক পর থেকে। তবে সেসময় সম্পূর্ণভাবেই রাগবির দুনিয়ায় ব্রাত্য ছিল বাংলা। ২০১০ সালে জলপাইগুড়ির এক গির্জার পারসি পুরোহিতের হাত ধরেই শুরু হয় বাংলার রাগবি-অভিযান। প্রাথমিকভাবে তাঁর উদ্যোগে মিশনারিতেই শুরু হয়েছিল রাগবি খেলা। এই খেলার প্রতি তরুণদের আগ্রহ ও পরিশ্রম রীতিমতো চমকে দিয়েছিল তাঁকে। তারপর তাঁর একক উদ্যোগেই গড়ে ওঠে রাগবি প্রশিক্ষণের আস্ত একটি সংগঠন ‘জঙ্গল ক্রোস’। 

বিগত এক দশক ধরে এই ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান থেকেই উঠে এসেছে একাধিক তরুণ প্রতিভা। এই সংগঠন থেকে উঠে আসা এক ডজনেরও বেশি তরুণী বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছেন ভারতের জাতীয় জুনিয়র ও সিনিয়র দলে। রাগবি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তরুণীদের শিক্ষাপ্রদান, প্রাইভেট টিউশন এবং ওয়ার্কশপেরও একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটি।

আরও পড়ুন
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে জেসিকা

বাংলার এই রাগবি খেলোয়াড়দের অধিকাংশেরই অভিভাবকরা চা বাগানের শ্রমিক। দৈনিক আয় বলতে মাত্র ২০০ টাকা। ফলে, অভাব অনটনের সঙ্গে লড়তে কেউ কেউ নিজেরাও বেরিয়ে পড়েছেন কাজের সন্ধানে। আর্থিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রয়েছে সমাজের চিরাচরিত ট্যাবুও। মহিলা হয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া আজও ‘অশোভন’ সমাজের চোখে। সেইসঙ্গে আঠারোর গণ্ডি পেরোলেই শুরু হয় বিবাহের চাপ। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন উত্তরবঙ্গের তরুণীরা। লড়াই করছে বাংলার ক্রীড়া সংগঠনটিও। জনসচেতনতা প্রচারই তাঁদের হাতিয়ার পরিস্থিতি বদলের।

আরও পড়ুন
প্রথম মহিলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট পেল আমেরিকা

সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রের ‘খেলো রাগবি’ প্রকল্পের দৌলতে খানিক সুযোগ-সুবিধা মিললেও, জাতীয় স্তরের রাগবি খেলোয়াড়দের জন্য সেভাবে কোনো আর্থিক সংস্থানই হয়নি প্রশাসনিক স্তরে। তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি রাজ্য সরকারও। সেই সাহায্য মিললে রাগবির গোটা পরিমণ্ডলটাই বদলে দেবেন বাংলার তরুণীরা, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। ভারতে রাগবির ‘বয়স’ মাত্র দু’দশক হলেও ২০১৬ সালের বিশ্বর‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী ৯৬টি দেশের মধ্যে ভারতের ক্রমাঙ্ক বর্তমানে ৭৭। উত্তরবঙ্গের তরুণীদের কাঁধে ভর করে আগামীদিনে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে ভারত, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী জলপাইগুড়ির সরস্বতীপুরের এই সংগঠনের কর্মকর্তারা…

আরও পড়ুন
পোপের পদে বসুন কোনো মহিলা, দাবি জার্মান ক্যাথলিকদের

Powered by Froala Editor