বাক্সবদল

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৫

টিফিন বাক্স আমাদের জীবনের প্রথম রহস্য, পুরস্কারও বলা যায়। মায়ের সঙ্গে এ এক লুকোচুরি খেলা। অসম বয়সের দুই আত্মীয়ের এই লুকোচুরি খেলা এক তুলনাহীন যোগসূত্রও বটে। যে খাবারের উপর নির্ভর করে এই পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, সেই পেটের জ্বালা নেভানোর ভরসাটুকু এই বাক্স। এই বাক্স কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে কোথাও কম নয়, একটি অচেনা ছেলে যে আজ টিফিন ফেলে এসেছে তার সামনে নিজের বাক্স বাড়িয়ে দিতে আমায় কেউ শেখায়নি, প্রথমদিন নিজে করেই ভালো লেগে গেছে বারবার। শিখেছি খাবারের কোনো ধর্ম হয় না। ঈদের লাচ্ছা আসা বাক্সে তাই মা ফিরিয়ে দিয়েছে লুচি আলুরদম। কখনও খালি কৌটো ফিরে যায়নি এখান থেকে কোথাও। 

এই ক্লাসরুমের জনাকয়েক বন্ধুই একদিন টিফিনবক্স ছেড়ে এগিয়ে এলাম পত্রিকার দিকে। ছোটপত্রিকা খায় না মাথায় দেয় কেউই জানি না তেমন। কেউ ল্যাং খেয়ে, কেউ আবার বান্ধবীদের স্বপ্নে দেখে তুমুল কবিতা লিখছি তখন। সেসবই পরিমার্জনা করে ছাপা হল পত্রিকা। উত্তরপাড়ার তরুণ তরুণীদের একটি বড় অংশ ক্রাউড ফান্ড করে চালানো শুরু করল এই কাগজ। প্রথম সংখ্যা সাড়ে চারশো, দ্বিতীয় এগারোশো আবার তৃতীয় থেকে পাঁচশোয় নেমে এল ছাপা। লিখে তো ফেলেছি, ছাপার জন্য তৈরিও হয়ে গেছে পত্রিকা, তারুণ্যের বলিষ্ঠতায় কিঞ্চিত পরিচিতিও পেয়েছে সেই কাগজ। কিন্তু জমে থাকা অতিরিক্ত সংখ্যাগুলি বিক্রি না হলে ক্রমশ ফেঁসে যাচ্ছে কিছু কিছু টাকা। অন্যের ভালোবাসায় সিক্ত এই পত্রিকার বোধহয় প্রথম হোঁচট খাওয়া এখানেই।

বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত হল বইমেলা যাওয়ার। সেখানে বসতে না পেলেও ঘুরে বিক্রি করা যাবে এই কাগজ। মানুষকে বলব নিজেদের কথা, খদ্দের আমার ঘরে না এলে, আমরাই না-হয় পৌঁছে যাব তার পাড়ায়। এই প্রথম আমরা জবাই হলাম প্রতিষ্ঠানের জাঁতাকলে। তারপর একটা আস্ত সার্কাস দেখলাম, যা বাবা-মার হাত ধরে কোনোদিনও দেখে উঠতে পারতাম না এই জগতে। নিশ্চিন্তির মধ্যে এটুকুই, প্রথমত আমরা আঁতেল নই, সকলেই খুব সাধারণ, দ্বিতীয়ত পিঠের ব্যাগে এখনও বই ছাড়াও একটা টিফিনবাক্স আছে, যতদিন এই দুটি জিনিস বহাল থাকবে, দুনিয়া জিতে নেব এমনই এক স্বপ্ন দেখে গেলাম আমরা।

আরও পড়ুন
বই কেন ঝাড়ে

কলকাতা বইমেলা আমাদের কাছে তখন কুম্ভের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, দাদা-দিদি, জ্যেঠু-জ্যেঠিমা কাউকে ছাড়লাম না, সকলকে জানালাম একটি পত্রিকা করে দেশোদ্ধার করছি আমরা। এর দাম খুবই অল্প, আপনারা পড়বেন কিনা সে নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই, তবে কিনে নিয়ে গেলে বাড়িতে কেউ না কেউ তো পড়বেই আপনার। আর সেইটুকুই বোধহয় আমাদের অবদান হবে বাংলা সাহিত্যে। প্রত্যেকটি পত্রিকা যা গছানো হয় না, যা জানানো হয় এবং মানুষ স্বেচ্ছায় কেনেন, তারা কিছু মানুষকে টেবিলে এনে বসান, পড়ার অভ্যাস দেন অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে।

আরও পড়ুন
হস্তাক্ষর

সারাদিনের এই ক্লান্তিকর ঘুরে বেড়ানো আর বইবেচার শেষে রাতে যখন স্টল বন্ধ হয়ে আসে, আমরা প্যাভেলিয়ানের সামনের মাঠে টাকার হিসাব মেলাই, তারপর বাক্স খুলে বসে শান্ত করি পেটের জ্বালা। কেউ ফল এনেছে, কেউ রুটি আলুভাজা, অনায়াসে মিশে যায় সব হাতে-হাতে। 

আরও পড়ুন
দূরপাল্লা

কিছুদিন এগোতেই মাঠ খালি হয়ে আসে, নানা কারণে বন্ধুবান্ধব অনেকেই সরে যায় পত্রিকা থেকে। পড়ে থাকার মধ্যে আমরা গুটিকয়েক, ছুটে বেড়াতে থাকি প্রেস, বাড়ি আর মেলায়। পত্রিকা তখন কেবল আর শখ নয়, মাছের তেলে মাছ ভাজার এক তাগিদও বটে। জেলায় জেলায় ছোটো ছোটো বইমেলায় স্টল ভাড়া দিয়ে বসতে শুরু করি আমরা, সেখানে ডুডল করা কভারের একটি বাংলা পত্রিকা মেহেন্দির বই ভেবে কিনে নিয়ে যান কেউ, কেউ প্রচ্ছদে পদ্মফুল থেকে ভাবেন ঠাকুরের বই। আমরা কাউকেই দমাই না। স্টলের মাটিতে উলটো ব্যানার পেতে ভাগে ভাগে চলে টিফিন খাওয়া। বন্ধুর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে আমার টিফিন, যে টিফিন আমি নিয়ে আসতে অস্বীকার করায় মা লুকিয়ে পাঠায় বন্ধুর হাতে। 

আরও পড়ুন
একান্নবর্তী

গত একদশকে আমাদের এই দল ক্রমশ বড়ো হয়েছে, প্রতিবছর তাতে ঢুকে আসছে আরও বন্ধুবান্ধব, ভাইবোন, এবং তাদের প্রেমিক প্রেমিকারা। বইমেলায় খাবারের দাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে বইকে। একটি কফির চেয়ে সস্তায় একফর্মার বই পাওয়া যাচ্ছে আমারই টেবিলে। আমরা তাই লাজুকভাবে সামলে নিচ্ছি খিদে। টেবিলের ধুলো মুছে হাত ধুয়ে আসছি, ব্যাগ গোছাবার জন্য টেবিলে বার করে রাখছি সেই বাক্স, তারপর জনা দশেকের মুখে ভাগে ভাগে উঠে যাচ্ছে মায়ের একবেলার পরিশ্রম। বন্ধুরা এ ওকে খাইয়ে দিচ্ছে এক কামড়, আমি জানি, এতগুলো মানুষের পেট ভরবে না সেই এক কামড়ে, তবু তাদের এই ভালো চাওয়ায় হয়তো কিছুদিন আরও বেশি বাঁচব আমি, সুস্থ থেকে যাবে আমার পরিবার...

Powered by Froala Editor