হস্তাক্ষর

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৩

আমারা যারা একই জামায় দু’তিনটে মানুষকে একসঙ্গে দত্তক নিয়ে রেখেছি, তারা জানি বইমেলা এই প্রত্যেকটা সত্তার প্রাণবায়ু। বহুক্ষণ অন্ধকার ঘরে থাকার পর বেরিয়ে এলে চোখে ধাঁধাঁ লেগে যাওয়ার সঙ্গেই কেমন যেন মনে হয় প্রাণ ফিরে পেল তারা। এই মানুষগুলোর মধ্যে কিছু কমন ফ্যাক্টর আছে, যেমন তারা একই চোখ, একই মুখ আর একই হাত ব্যবহার করে। ধরে নেওয়া যাক পরিচিত কোনও তরুণী ফেসবুক থেকে উঠে এসে টেবিলে দাঁড়াল আমার, ধীরে চোখ বুলিয়ে খুঁজে নিচ্ছে তার ভেবে রাখা বই, আমি শান্ত চোখে হাতে তুলে নিচ্ছি ক্যাশমেমো আর মুখস্থ থাকা বইয়ের দামও পাতা উলটে দেখবার অভিনয় করছি। 

বিল কাটার কিছু নিয়ম আছে প্রত্যেক পত্রিকার, বইয়ের নাম, দাম, ছাড়, দিন ছাড়াও একটি সই থাকে সেখানে। যে সই কোনোদিন আর কাজে লাগবে না কারুর, অথচ সেও তো আমারই এক সত্তার। পরক্ষণেই বইগুলো হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করবে, ‘আকাশদা তো? লিখে দেবে না বইয়ে?’, এ এক অদ্ভুত অস্বস্তি আমার। বেসুরো লোককে ফ্যামিলি গ্যাদারিং-এ গান গাওয়াবার মতো অস্বস্তি। এই খারাপ হাতের লেখা ঢেকে রাখা ছিল ছাপা অক্ষরের আড়ালে, যা কেবল জানতাম আমি, আমার প্রকাশক এবং তাঁর ডিটিপি টাইপিস্ট। এরপর এই বই হাতে হাতে ঘুরবে। আমার দুর্বলতা নিয়ে চর্চা হবে বন্ধুমহলে। তারা হাসুক অথবা এড়িয়েই যাক, মনে হবে কেন লিখতে এলাম, কেবলই নিজের ভালোলাগে বলে?

আত্মজীবনীর জন্য যে অধ্যাবসায় লাগে আমি তার ন্যূনতমও অর্জন করিনি এই ছোটো জীবনে। সকালের ঘুমে এখনও মৃত্যুসংবাদ এলে মনে হয় কাকে বলে হালকা হব? মা-বাবার সঙ্গে অশান্তি, কথা বন্ধ কয়েকদিন হল, তাও গিয়ে দাঁড়াই, বলে ফেলি সব। বন্ধু মারা গেছে। তার মা নেই, বাবা গেছেন পোস্ট মর্টেমে সই করতে। এ সই বোধহয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার চেয়েও কঠিন। সকাল থেকে জল খেতে গিয়ে গায়ে ফেলে দিচ্ছি জল, নিজের অজান্তেই এই কেঁপে ওঠা। আঠাশ উনত্রিশ-এর এই জীবন বাকি ফেলে যদি আমিও যাত্রা করি সে পথে, যদি আর কেউ কখনও খুঁজে না পায় টেবিলে? বইমেলায়? এই ভয় থেকেই কাগজে লেখা, পাসওয়ার্ড রাখা নেই ল্যাপটপে। বন্ধুরা হয়তো খুঁজে নেবে কেউ, কত কত আত্মজীবনীর টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে এখানে। 

আরও পড়ুন
দূরপাল্লা

একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠার থেকে চুপিচুপি চলে যাওয়া হয়তো অনেক আদরের। কোনও পিঠ চাপড়ানো নেই, ঠান্ডা শুয়ে থাকা আর দেখা সকলকে। ‘আকাশদা লিখে দাও...’ এভাবে টুকরো টুকরো লেখা ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বইমেলা, কারুর পিঠের ব্যাগে, কারুর হাতে কারুর চাউমিনের প্যাকেটে লেপ্টে দুলতে দুলতে ছড়িয়ে যাচ্ছি আমিও। পরিচিত বোন তার প্রতিবেশীর ছবিতে খুঁজে পেয়ে জানাচ্ছে আমায়। বাড়ি ফিরে এসে তাই অন্য জীবনে বাঁচছি এই একই শরীরে। সই এক অদ্ভুত জিনিস, জায়গা বিশেষে বদলে যায় তার মূল্য, প্রয়োজন, চাহিদাও। কোথাও ব্যালেন্স শিটে, কোথাও লোনের কাগজে, কোথাও বইয়ের সামনের পাতায় আবার কোথাও পালিয়ে আসা বন্ধুর বিয়েতে সাক্ষী হয়ে সই করে যাচ্ছি আমরা পাশাপাশি, কয়েকজন বন্ধু। বন্ধু চলে গেছে, হাজার কাঁটাছেড়ার পর যে দেহাবশেষটুকু ছাই হবে আজ, সেখানেও সই, এক বয়স্ক বাবা এসে স্বীকার করে নেবেন, কোনোদিন আর একগ্লাস জল বাড়িয়ে দিতে পারবে না তাঁর পুত্র...

চিত্রগ্রাহক - অরিজিৎ পোদ্দার

আরও পড়ুন
একান্নবর্তী

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বইমেলায় কাউন্টার টেবিলে চড়ে অপেরা স্টাইলে গান ধরতেন পীযূষকান্তি সরকার