সূর্যস্নান - ৮
সময়টা ১২৭৯ বঙ্গাব্দের শীতের শুরুর দিক (১৮৭২ সালের শেষভাগ)। হিমালয়-ভ্ৰমণান্তে কলকাতায় ফিরেছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখন তাঁকে দুই কনিষ্ঠ পুত্র ও জ্যেষ্ঠ দৌহিত্রের উপনয়ন-সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। ঠাকুর পরিবারে এতদিন ধরে হিন্দুসমাজের ব্রাহ্মণ্য লোকাচার ও ধর্মসংস্কার নিষ্ঠার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এখনও পর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলেদের উপনয়ন-সংস্কার প্রাচীন হিন্দুমতেই হয়েছে। কিন্তু এইবার, মহর্ষি পরিবর্তন চাইলেন।
সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের উপনয়ন যাতে অপৌত্তলিক ভাবে ও বৈদিকমতে অনুষ্ঠিত হয়, দেবেন্দ্রনাথ তার আয়োজন শুরু করলেন। আচার্য আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের সঙ্গে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে বৈদিক মন্ত্র চয়ন করলেন মহর্ষি, সংকলিত হল এক অভিনব উপনয়ন-অনুষ্ঠান-পদ্ধতি।
লৌকিক হিন্দু-আচার অনুসারে উপনয়ন প্রভৃতি অনুষ্ঠানের সময়ে শালগ্রাম-শিলার প্রয়োজন অনিবার্য। আবার উপনয়ন যেহেতু বৈদিক দীক্ষাবিধি, তাই নানা যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানও এর সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। উপনয়নের সঙ্গে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পূজাপাঠ ও হোমযজ্ঞ প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান বর্জন করে দেবেন্দ্রনাথ বিশুদ্ধ ও অভিনব উপনয়নবিধি প্রণয়ন করলেন। মূল অনুষ্ঠানের আগে, বহুদিন ধরে সেইসব মন্ত্র বিশুদ্ধ রীতিতে বারংবার আবৃত্তি করিয়ে বালকদের শিখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন দেবেন্দ্রনাথ।
মাঘোৎসবের কয়েকদিন পরে বালক রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হল। তখন তার বয়স এগারো বছর নয় মাস। এই অনুষ্ঠানে বেদান্তবাগীশ মহাশয় পৌরোহিত্য করলেন, আচার্যের পদ নিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ। মহর্ষি বেদী থেকে যে উপদেশ দিলেন, তাতে উপনয়নের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বেশ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সংস্কৃত ও সংশোধিত উপনয়ন-বিধি প্রাচীন বা নবীন - কোনো দলেরই মনঃপূত হল না। উপনয়নের এই নতুন পদ্ধতি গতানুগতিক আচার ও প্রচলিত মন্ত্রাদির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় - তাই প্রাচীনপন্থীদের পক্ষে স্বভাবতই ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কঠিন। আবার বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের দিক থেকে উপনয়নের মতো প্রাগৈতিহাসিক সংস্কারকে নবীন ব্রাহ্মদের পক্ষেও সমর্থন করা অসম্ভব। সত্যিই, ব্যাপারটা খুবই সমস্যার!
আরও পড়ুন
যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও
মহর্ষির একান্ত অনুগত বন্ধু রাজনারায়ণ বসুর মনে এই অনুষ্ঠান সম্বন্ধে দ্বিধা জন্মেছিল অবশ্যই। কিন্তু তিনি বিরাট হিন্দুজাতীয়তার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাই ইতিপূর্বে যেমন অনেক অযৌক্তিকতার সঙ্গে আপোস করে নিয়েছিলেন, এবারও তাই করলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে এই উপনয়ন সম্বন্ধে কী লিখেছিলেন, আমরা একটু পড়ে নেব। “শ্ৰীমৎ প্রধান আচার্য প্রাচীন উপনয়ন-পদ্ধতি যতদূর ব্রাহ্মসমাজে প্রবর্তিত করা যায় তাহা করিলেন। পূর্বে যে-অনুষ্ঠান পদ্ধতি প্রকাশিত হয় তাহাতে উপনয়ন বলিয়া একটি ক্রিয়া আছে বটে, কিন্তু তাহা কেবল ব্রাহ্ম উপদেষ্টার নিকটে কোনো বালককে আনিয়া তাঁহার উপর তাহার ধর্ম ও শিক্ষার ভার অর্পণ করা। ...কিন্তু নূতন প্রবর্তিত উপনয়ন-পদ্ধতিতে গায়ত্রীমন্ত্রে দীক্ষাপূর্বক উপবীত গ্রহণ করার নিয়ম প্রবর্তিত হইল। পৌত্তলিকতা ছাড়া ব্রাহ্মণ্য সকল নিয়ম পালন করিয়া উপনয়নক্রিয়া সম্পাদিত হয়। ...প্রথমে আমি নূতন উপনয়ন-প্রথার বিপক্ষে ছিলাম, কিন্তু এরূপ উপনয়ন ব্যতীত আদি ব্রাহ্মসমাজের হিন্দু অনুষ্ঠান-পদ্ধতি সর্বাবয়ব সম্পন্ন হয় না, ইহা বিবেচনা করিয়া তাহাতে যোগ দিয়াছিলাম।” স্পষ্টতই, দ্বিধাকে সরিয়ে রেখে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন রাজনারায়ণ।
আরও পড়ুন
ভেসে এল কান্নার শব্দ, মেয়েকে শেষবার না-দেখেই গাড়ি ঘোরালেন রবীন্দ্রনাথ
বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে অবশ্য এসব সামাজিক মতানৈক্যের আঁচ পৌঁছোয়নি। মাথা মুড়িয়ে, বীরবৌলি পরে তাঁরা তিন বটু তিনতলার ঘরে তিন দিনের জন্য আবদ্ধ হলেন। দিনগুলো তাঁদের ভারী আনন্দে, উচ্ছল কৌতুকে কেটেছিল। এমনকি, পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরে টানাটানি করতেও তখন কসুর করেননি তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "বস্তুত, গুরুগৃহে ঋষিবালকদের যে-ভাবে কঠোর সংযমে দিন কাটিবার কথা আমাদের ঠিক সে-ভাবে দিন কাটে নাই। আমার বিশ্বাস, সাবেক কালের তপোবন অন্বেষণ করিলে আমাদের মতো ছেলে যে মিলিত না তাহা নহে; তাহারা খুব যে বেশি ভালোমানুষ ছিল, তাহার প্রমাণ নাই।"
আরও পড়ুন
তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী
নতুন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করার দিকে রবীন্দ্রনাথের খুব ঝোঁক পড়ল। তিনি বিশেষ যত্নে, একাগ্র চিত্তে ওই মন্ত্র জপ করার চেষ্টা করতেন। সে বয়সে গায়ত্রীর অর্থ সম্পূর্ণ উপলব্ধি করার মতো পরিণতমনস্কতা তাঁর কাছে আশা করা যায় না, কিন্তু তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। মন্ত্রের "ভূর্ভুবঃ স্বঃ" এই অংশকে অবলম্বন করে বালক মনটাকে বহুদূর অবধি প্রসারিত করতে চেষ্টা করতেন। পড়ার ঘরে, শান বাঁধানো মেঝের এক কোণে বসে গায়ত্রী জপ করার সময় একদিন হঠাৎ তাঁর দুই চোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বন্যা এল। এই স্মৃতি বহুদিন ধরে তাঁর মনে ছিল। সেই বালকবয়সে এই মন্ত্রের রহস্য তাঁর কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট না হলেও, মন্ত্রের অন্তর্নিহিত ভাব যে তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীতে ঘা দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন
‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও মননে উপনিষদের মন্ত্রাদি, বিশেষত গায়ত্রী মন্ত্রের প্রভাব অতি গভীর। পিতা দেবেন্দ্রনাথ প্রত্যহ প্রাতে অভুক্ত অবস্থায় দশবার গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাধ্যমে ব্রহ্মোপাসনা করতেন। পিতার প্রভাব পুত্রের জীবনেও পড়েছিল সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ উত্তরজীবনে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছিলেন, ছোটো মেয়ে মীরার বিয়ের সময়ে জামাতা নগেন্দ্রনাথকে উপবীত পরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে নিস্পৃহতা এলেও, গায়ত্রীর অন্তর্নিহিত অর্থ চিরকাল তাঁর হৃদয়ে ভাস্বর ছিল।
আরও পড়ুন
নিতান্ত ছেলেবেলাতেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ-চর্চা
'সত্যকে দেখা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা সৃষ্টিকর্তাকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই ধ্যান করি। অনন্ত লোক তাঁর থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে, তাঁর থেকেই প্রেরিত হচ্ছে আমাদের প্রতি মুহূর্তের চৈতন্য- এই আমাদের ধ্যান। তিনি বলেছেন, "অগণ্য ঘটনাকে অগণ্য ঘটনারূপে দেখেই চলে যাব না--তার মাঝখানে অনন্ত সত্যকে স্থির হয়ে স্তব্ধ হয়ে দেখব এইজন্যই আমাদের ধ্যানের মন্ত্র গায়ত্রী।"
আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে চালু ছিল ভূত-প্রেতের গল্পগুজব
গায়ত্রী মন্ত্রের রবীন্দ্রকৃত এক অতি সরল, অতি মধুময় ভাবানুবাদ আছে এই লেখায়। সেটি হোক আমাদের আজকের আলোচনার অন্তিম পুষ্পাঞ্জলি।
আরও পড়ুন
বাংলার ছড়া তাঁর কাছে 'জাতীয় সম্পত্তি', চিরন্তনতায় মুগ্ধ হয়েছেন বারবার
"ভূলোক, ভুবর্লোক, স্বর্লোক, ইহাই যিনি নিয়ত সৃষ্টি করছেন, সেই দেবতার বরণীয় শক্তিকে ধ্যান করি--যিনি আমাদের ধীশক্তিকেও নিয়ত প্রেরণ করছেন।"
Powered by Froala Editor