চাঁদে মানুষের পা, নাকি স্টুডিয়োয় শুটিং? কুবরিকের দাবি ও অন্যান্য রহস্য

লাইট.. ক্যামেরা.. অ্যান্ড অ্যাকশন... এগিয়ে যাচ্ছে ক্যামেরার লেন্স। তারাহীন কালো আকাশের নিচে দেখা যাচ্ছে চাঁদের ধূসর মাটি। সেখানে পোঁতা একটি আমেরিকার পতাকা। চাঁদের বাতাসহীন আবহাওয়ায় একটু দুলে উঠল কি? এবার ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে নীল আর্মস্ট্রং-কে (Neil Armstrong)। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়া প্রথম মানুষ। আনন্দে লাফাচ্ছেন। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর থেকে ছ-গুণ কম। তাই হয়তো একটু বেশি লাফানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে তাঁর জন্য। অন্যদিকে এডুইন ‘বাজ’ অলড্রিন মহাকাশযান ‘অ্যাপোলো ১১’-এর পরিচর্যা করছেন। চাঁদের মাটিতে পায়ের স্পষ্ট ছাপ। আমেরিকার পতাকার দিকে স্যালুট করলেন অলড্রিন। অ্যান্ড... কাট। 

একেই বলে শুটিং! চলছে চাঁদে মানুষের প্রথম পদার্পণের চিত্রগ্রহণ। চাঁদে নয়, পৃথিবীরই কোনো এক দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে। পরিচালনায় স্ট্যানলি কুবরিক (Stanley Kubrick)। প্রযোজনা ও সামগ্রিক পরিকল্পনায় ‘নাসা’ এবং আমেরিকা সরকার। 

এমনটাই বিশ্বাস করেন ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’-রা। তাঁদের মতে, ‘অ্যাপোলো ১১’ আদৌ চাঁদের মাটিতে পা-ই দেয়নি। পুরোটাই ক্যামেরার কারসাজি আর স্পেশাল এফেক্টস-এর খেলা। এই গ্রহে বসে বানানো একটি চমৎকার সিনেমা। কানাঘুষো চিরকালই ছিল। ১৯৯৯ সালে কুবরিকের একটি সাক্ষাৎকার সামনে আসতেই পাওয়া গেল মোক্ষম অস্ত্র। খোদ পরিচালক দায়িত্বের সঙ্গে স্বীকার করেছেন, চন্দ্রাবতরণের পুরো চিত্রনাট্য তাঁর নিজের হাতে তৈরি। মৃত্যুর তিন দিন আগে নাকি চিত্রপরিচালক প্যাট্রিক মারে-কে এমন কথাই বলে গেছিলেন কুবরিক। 

১৯৬৯ সালে আমেরিকা প্রথম চাঁদে মানুষ পাঠায়। সওয়ারি তিনজন হলেও চাঁদের মাটিতে নেমেছিলেন আর্মস্ট্রং ও আর্নল্ড। আছে একাধিক ভিডিও ফুটেজ। প্রমাণ হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন চাঁদের পাথর। কিন্তু খুঁত ধরতে ছাড়েনি ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’-রা। তার এক বছর আগেই কুবরিকের ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মাধ্যমে চন্দ্রাভিযান পর্যন্ত সবই ধরা আছে কালজয়ী সিনেমাটিতে। তখনই নাকি তাঁকে ধরেন ‘নাসা’-র লোকজন। তাঁদের জন্যও চাঁদে যাওয়ার একটা সিনেমা বানিয়ে দিতে হবে। নাহলে যে ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে রাশিয়ার কাছে হার মানতে হয়। ১৯৬১-তেই ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে তারা। এখন চাঁদে মানুষ না পাঠালে যে অপমানের একশেষ!

আরও পড়ুন
চাঁদে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের, কী হল শেষমেশ?

‘স্পেস ওডিসি’-র জন্য নাসার অনেক বিজ্ঞানীরই সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি, এবারও এগিয়ে এলেন তাঁরাই। এভাবেই নাকি কুবরিকের নির্দেশনায় তৈরি হয় ‘অ্যাপোলো ১১’-র অভিযান।

আরও পড়ুন
চাঁদ-মঙ্গলের পর এবার গ্রহাণুতেও শহর তৈরির পরিকল্পনা! নকশা বানালেন বিজ্ঞানীরা

ওই ছয়ের দশকেই ‘নাসা’-র সঙ্গে যুক্ত ১০ জন মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। কেউ প্লেন দুর্ঘটনায়, কেউ বা অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে। তবে কি তাঁরা কোনো গোপন খবর ফাঁস করতে চলেছিলেন? সেই কারণেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁদের? 

১৯৭৬-এ মার্কিন রকেট প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিল কেসিং-এর ’আমরা কখনও চাঁদে যাইনি’ বইটিতে কিছু চাঞ্চল্যকর দাবি করেন। তিনি বলেন চাঁদ তো দূরের কথা, অ্যাপোলো ১১ পৃথিবীর সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করেনি। বরং মহাকাশযান থেকে লুনার ক্যাপসুলটি প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর কোনো একটি অজানা অঞ্চলে চলে পুরো সিনেমা। আবার ২০০২ সালে ফ্রান্সে একটি ‘মকুমেন্টারি’ বেরোয়। নাম— ‘ওপারেশন লুন’। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এটি। সেখানে পুরো সিনেমাটা কীভাবে বানানো হয়েছে, সেটি নিয়ে একটি সিনেমা বানানো হয়।

হাজারো প্রশ্নে জেরবার হতে থাকে নাসা। কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্ন তোলেন জাপানী বিজ্ঞানী মিশিও কাকু। চাঁদে বাতাস না থাকতেও আমেরিকার পতাকা কীভাবে ওড়ে? মহাকাশচারীদের ছবিতে চাঁদের অন্ধকার আকাশে কোনো তারারও দেখা নেই। এত বড় একটা বস্তু এত বেগে চাঁদের মাটিতে নামল, অথচ মাটিতে অভিঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না! চারিদিকে এত ছায়াই বা আসছে কোথা থেকে? নাসার দাবি ছিল ‘অ্যাপোলো ১১’ গেছে ‘ভ্যান অ্যালিয়েন রেডিয়েশন বেল্ট’ দিয়ে। যদিও কাকুর যুক্তি, ওই বেল্ট দিয়ে অতটা সময় ধরে গেলে মহাকাশচারীরা ঝলসে যেত। নাসা এই সব প্রশ্নের কোনোটার উত্তর দিয়েছে, কোনোটা এড়িয়ে গেছে, কোনোটা আবার আরও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কখনও বলেছে ছবি নিম্ন মানের, কখনও বা বলেছে ডেটা হারিয়ে গেছে। 

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতু হয়ে আসছিল অনেক কিছুই। ‘অ্যাপোলো ১১’-র আমেরিকার ফ্ল্যাগ-টির শুয়ে পড়া ছবিটিও চাঁদের মাটিতে দেখা গেছে। কুবরিকের পরিবারের তরফের ফিল্ম বানানোর দাবি নস্যাৎ করা হয়। পিছু হটতে শুরু করেছিলেন গুজববাদীরা। কিন্তু তাঁরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেন ২০১৭-তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞান উপদেষ্টা ডেভিড গেলার্নটারের বক্তব্য শুনে। তখন সদ্য ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল তিনের দশকের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানো সম্ভব? উত্তরে গেলার্নটার জানান, আমরা এখনও চাঁদেই মানুষ পাঠাতে পারলাম না, মঙ্গলে আর কীভাবে পাঠাব? ওসব আগের ওবামা সরকারের মাথাব্যথা ছিল। এখন এসব খুবই হাস্যকর। যেন একপ্রকার মেনেই নিলেন আমেরিকার চাঁদে যাওয়াটা একপ্রকার ‘সাজানো ঘটনা’।

অতএব? ঘুরে-ফিরে আসছে কি সেই এক প্রশ্ন? আদৌ আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল? নাকি সত্যিই কুবরিকের কারুকার্য? প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে চাঁদের বাতাসে। ও না, ভুল হল। চাঁদে তো বাতাসই নেই।

তথ্যসূত্র :
Moon Landing Conspiracy Theory, Wikipedia
How Stanley Kubrick Staged the Moon Landing, The Paris Review, July 18, 2019
Michio Kaku- Moon Landing Hoax, Cuckoo for Kaku, Youtube

Powered by Froala Editor

More From Author See More