ভাঙা পড়ছে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’, কেন?

স্বাধীনতার কিছু বছর পরের কথা। দেশ ছেড়ে বহু মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন ইংল্যান্ডে। সবাই যে সামর্থ্যবান, তা নয়। রুটি-রুজির টান রয়েছে। বিদেশের মাটিতে জীবন গড়ে তুলতে হবে নতুন করে। অথচ ভাষা জানেন না, আইনি সমস্যায় জেরবার জীবন। অতিথিদের সুনজরে দেখছে না ইংল্যান্ডের লোকেরাও। তবে কি ফিরে যেতে হবে? এগিয়ে এলেন কৃষ্ণ মেনন। ১৯৫১ সালে লন্ডনে গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’। ইংল্যান্ডে প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে এলেন এক ছাতার তলায়। দীর্ঘ ৭০ বছর পথ চলার পর অবশেষে ধ্বংসের মুখে এই বাড়ি। 

কৃষ্ণ মেনন ছিলেন ইংল্যান্ডে স্বাধীন ভারতের ইংল্যান্ডের প্রথম হাই কমিশনার। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রাথমিক খসড়া তাঁর লেখা। খোদ লন্ডনে বসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডে গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিয়া লিগ’। সেখানেও ভারতপ্রেমী মানুষের অভাব নেই। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকেন। ১৯৩৩-এ তাঁদের একাংশকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের নমুনা দেখানোর জন্য। চাপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে। অবশ্য স্বাভাবিক কারণেই স্বাধীনতার পর লিগ বন্ধ হয়ে যায়। 

কিন্তু কাজ শেষ তখনও হয়নি। আন্তর্জাতিক শিবিরে ভারতের শত্রুর অভাব নেই। এককালে শাসক থাকলেও, ইংল্যান্ডের সাহায্য প্রয়োজন পড়তে পারে। চরমপন্থী নীতিতে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে ভারতপ্রেমীদের সঙ্গেও। তাই ভারত-ইংল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে একটা সাধারণ সামাজিক মেলামেশার জায়গা দরকার। এদিকে বহু মানুষ আসছেন দেশ থেকে। সাহায্য প্রয়োজন তাঁদেরও। তাই প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও লেডি মাউন্টব্যাটেনের সহায়তায় কৃষ্ণ মেনন গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’-এর ঠিকানা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের কালে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’। আসলে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করেছিল ভারতের অবস্থানকেই। ভারতীয় সাংবাদিকদের সংগঠন, ইংল্যান্ডে ভারতীয় শ্রমিক সংগঠন ও সোশ্যালিস্ট দলের নিয়মিত আলোচনাচক্র বসত এখানে। ইংরেজ-ভারতীয় নিয়মিত আড্ডায় সরগরম হয়ে থাকত ক্লাবটি।

আরও পড়ুন
নারীমূর্তির চেয়ে জন্তুর মূর্তি বেশি লন্ডনের রাস্তায়!

প্রথমে ঠিকানা ছিল চ্যারিং ক্রসের ক্র্যাভেন স্ট্রিটে। পরে সরে আসে ১৪৩-১৪৫ স্ট্রান্ডে। ক্লাব মেম্বারদের বদলে প্রবেশ অবাধ করে দেওয়া হয়। গত ২৬ বছর ধরে এখানে ইয়াদগার মার্কার ও তাঁর মেয়ে ফিরোজা একটি ভারতীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছিলেন। 

আরও পড়ুন
লন্ডনের নিলামে প্রায় ৫ কোটি টাকায় বিক্রি হল রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

বর্তমানে বিপদে এই ক্লাবের অস্তিত্ব। ২০১৭-তে ওয়েস্টমিনিস্টার কাউন্সিল বিল্ডিং-টি ভেঙে ফেলার আদেশ দেয়। ইয়াদগার ও ফিরোজা ‘সেভ ইন্ডিয়া ক্লাব’ তৈরি করে আড়াই লক্ষ মানুষের সইও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে আদেশ। ১৭ সেপ্টেম্বর শেষবারের মতো দরজা খুলবে ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’-এর। তারপর গড়ে উঠবে বিলাসবহুল হোটেল। বহু ইতিহাসের সাক্ষী হলুদ দেওয়াল থেকে পুরনো ছবিগুলো নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে। খোদ লন্ডনের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। 

অবশ্য এ দেশে এমনটা হামেশাই ঘটে থাকে। অজস্র ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভাঙা পড়ে ‘উন্নয়ন’-এর কোপে বা অন্যান্য কারণে। মৃত্যু ঘটে ইতিহাসের। সেখানে সুদূর লন্ডনের খবর নিয়ে কি আদৌ বিচলিত হবেন দেশবাসী?

Powered by Froala Editor