স্বাধীনতার পর, সরকারের দেওয়া পেনশন নিতেও অস্বীকার করেন বীণা

মাত্র ২১ বছর বয়স তখন তাঁর। সামনে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। সবার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ-পাঁচটি গুলি ছুঁড়লেন গভর্নরের দিকে। মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে, বা রাখেনি। তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবী কন্যা বীণা দাস।

১৯১১ সালের ২৪ আগস্ট কৃষ্ণনগরে শিক্ষক বেণীমাধব দাস এবং সমাজকর্মী সরলা দেবীর কোল আলো করে আসেন বীণা। বেণীমাধব দাস সেই সময়ের একজন শিক্ষক। সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর ছাত্র ছিলেন।

বীণার দিদি কল্যাণী দাসও মুক্তিযোদ্ধা। স্কুলজীবন থেকে দুই বোনই ব্রিটিশ-বিরোধী মিছিলে পা মেলাতেন। তাঁর মা সরলা দেবীও জনসাধারণের কাজে নিবেদিত প্রাণ। নিঃস্ব মহিলাদের জন্য 'পুণ্যশ্রম' নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর উদ্যোগেই।

১৯২৮ সালে ছাত্রী সংঘে (মহিলা ছাত্র ইউনিয়ন) যোগ বীণা দাসের। ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল, ভিক্টোরিয়া স্কুল, বেথুন কলেজ, ডায়োসেসান কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নরত মহিলা শিক্ষার্থীদের নিয়েই এই ইউনিয়ন। একশো সদস্যের এই ছাত্রী সংঘ বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘরও। সংঘের সদস্য-ছাত্রীরা লাঠিখেলা, তলোয়ার ব্যবহার শেখার পাশাপাশি নেন সাইকেল এবং গাড়ি চালানোর তালিমও। দেশসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই আবার বাড়িঘর ছেড়ে সরলা দেবীর 'পুণ্যশ্রম'-এ থাকতে শুরু করেন। এই 'পুণ্যশ্রম' অনেক বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাক্ষী। পুণ্যশ্রমের গুদামঘরেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র, বোমা ইত্যাদি মজুত রাখা হত।

আরও পড়ুন
বিপ্লবীর স্মৃতিজড়িত দুর্গাপুজো, আড়বালিয়া ও একশো বছরের কিস্‌সা

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন উপনিবেশবাদ বিরোধী   উপন্যাস 'পথের দাবী'। রীতিমতো হইচই ফেলা এই উপন্যাস ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞার কারণে 'পথের দাবী' পড়ার কৌতূহলও বেড়ে যায়। এর প্রথম সংস্করণ গোপনে মাত্র সাত দিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। হৃদয়ে বিপ্লবের আগুন জ্বলা বীণা দাসও গোপনে উপন্যাসটির একটি কপি পেয়েছিলেন। ম্যাট্রিকের পড়াশোনা পরে হবে। শরৎ-উপন্যাস পড়াই তখন সবার আগে দরকার। উপন্যাসটি চূড়ান্ত প্রভাব ফেলে বীণার জীবনে। ইংরেজি পরীক্ষায় যখন প্রিয় উপন্যাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, 'পথের দাবী'র বিস্তারিত বর্ণনা তখন বীণার মুখে। যার জেরে নম্বরও কম পান। 

আরও পড়ুন
বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে বই লিখে রাজরোষে ঠাকুরবাড়ির সৌমেন্দ্রনাথ

দু-বছর পর তাঁর সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার কর্পসে যোগ। এখানে কাজ করতে করতেই সহ-বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলির সহায়তায় বেঙ্গল রেভ্যুলিউশনারি পার্টির সদস্যপদও গ্রহণ করেন।

১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই তথ্য পেয়ে বীণা দাস জ্যাকসনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একই সমাবর্তনে তাঁর ডিগ্রি নেওয়ার কথা ছিল। যুগান্তর পার্টির বিপ্লবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, জ্যাকসন তাঁরই নিশানার চাঁদমারি। গভর্নর জ্যাকসন বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের ট্রিগারে চাপ। সাহেবের কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায় সব বুলেটই। ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার বীণা দাসকে পরের দিনই আদালতে হাজির করে ন'বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিচারপর্বে তাঁর সহযোগীদের নাম প্রকাশের জন্য তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করা হলেও টলানো যায়নি বীণাকে। বিচার চলার সময় বলেন, 'বাংলার গভর্নর এমন একটি ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করেন যা আমার ৩০ কোটি দেশবাসীকে দাসত্বে রেখেছে। স্বীকার করছি, সিনেট হাউসে শেষ সমাবর্তনের দিন আমি গভর্নরের দিকে গুলি চালিয়েছিলাম। এর জন্য আমি নিজেকে সম্পূর্ণ দায়ী মনে করি। মৃত্যু যদি আমার নিয়তি হয়, তবে আমি তা অর্থবহ করতে চাই। এই লড়াই অত্যাচারী সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই, যা আমার দেশ ও দেশবাসীর উপর অগণিত অত্যাচার চালিয়েছে।’

সাহিত্যিক মকরন্দ পরাঞ্জপের স্মৃতিকথা অনুসারে, বীণা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করতেন। কীভাবে? কখনো বিষাক্ত পিঁপড়ের বাসায় পা রেখে, কখনো-বা আগুনের শিখায় আঙুল সেঁকে চলত কষ্ট সহ্যের অনুশীলন।

১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক সরকার গঠনের পর রাজবন্দিদের জেল থেকে মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে অন্যান্য রাজবন্দির সঙ্গে মুক্তি পান বীণা দাসও। এরপর তাঁর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ। কিন্তু তাঁর নামেই ভয়ে কাঁপত ব্রিটিশরাজ। এই কারণেই তিন বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল বীণা দাসকে।

১৯৪৭ সালে যুগান্তরের সদস্য, স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে নিজেকে বিবাহবন্ধনে বাঁধেন। রাজনীতিতেও সক্রিয় বীণা ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। গান্ধিজির নোয়াখালি সফরের সময় জনগণের পুনর্বাসনের কাজেও সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কলকাতা ছেড়ে হৃষিকেশে একটি আশ্রমে বসবাস শুরু করেন। প্রবল আত্মমর্যাদাশীল বীণা দাস সরকার প্রদত্ত পেনশন নিতে অস্বীকার করে জীবিকা অর্জনের জন্য পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। 

স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেওয়া এই বীরাঙ্গনার জীবনের শেষ পর্বটি খুবই বেদনাদায়ক। ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাস্তার পাশে মেলে খণ্ডিত একটি মৃতদেহ। পুলিশ প্রায় একমাস তদন্তের পর নিশ্চিত হয় এই লাশ বীণা দাসের। মহান এই বিপ্লবী অগ্নিকন্যার জীবনের শেষ পরিণতি দেখে শিউরে উঠতে হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী, অধ্যাপক সত্যব্রত ঘোষ তাঁর 'ফ্ল্যাশব্যাক: বীণা দাস- রিবর্ন' প্রবন্ধে লিখছেন, 'ঘটনাটি সেই স্বাধীন ভারতে ঘটেছিল যার জন্য এই অগ্নিকন্যা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।'

Powered by Froala Editor