একসময় আকাশের দিকে তাকালে হামেশাই দেখা যেত দীর্ঘ বাঁকানো ঠোঁট নিয়ে বিশাল ডানা উড়িয়ে ভেসে চলেছে শকুনের দল। কোথাও কোনো মৃতদেহ থাকলে তো কথাই নেই। আজ এই প্রাণীদের আর প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। ৯০-এর দশকেই ভারতের ৯০ শতাংশ শকুনের বিলুপ্তি ঘটেছে। আর যা বেঁচে আছে, তাদের ভবিষ্যতও খুব একটা নিরাপদ নয়। সরকারিভাবে অবশ্য নানা ধরনের সংরক্ষণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শকুনের মৃত্যুর জন্য দায়ী বিষ আজও সমানভাবে বিক্রি হয়ে চলেছে বাজারে।
অবশ্য ‘বিষ’ কথাটির ব্যবহার এখানে সম্পূর্ণ ঠিক নাও হতে পারে। কারণ এই বিষই আবার কারোর কারোর কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ। গবাদি পশুদের ব্যথা উপশমের জন্যই মূলত ব্যবহার করা হয় নিমোসুলাইড নামক ড্রাগটি। আর এই ড্রাগটিই শ্বেতপুচ্ছ শকুনদের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। কেননা, মৃত গবাদি পশু খাওয়ার সময় শকুনদের শরীরে প্রবেশ করে এই ড্রাগও। সম্প্রতি এনভারনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ সেন্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন ভারতের বনবিভাগের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।
২০১৯ সালে গুজরাটের দুটি পৃথক জায়গা থেকে মোট ৪টি শ্বেতপুচ্ছ শকুনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এমনিতেই পৃথবীর বিরলতম প্রাণী প্রজাতিগুলির একটি এই শকুন। আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় তো নাম আছেই, ভারতের বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইনের প্রথম তফসিলেও এই শকুনের উল্লেখ আছে। ফলে নড়েচড়ে বসে বনবিভাগ। মৃতদেহগুলির শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু তাদের মৃত্যু স্বাভাবিক নয় বলেই সন্দেহ হয় তদন্তকারী অফিসারদের। শুরু হয় ময়না তদন্ত। আর তারপর সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন গবেষকরা। নিমোসুলাইড নামক পেইন-কিলারের জন্যই মৃত্যু হয়েছে ৪টি শকুনের।
২০০৬ সালে শকুনের মৃত্যু আটকাতে প্রথম ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন আনে সুপ্রিম কোর্ট। গবাদি পশুর ব্যথা উপশমের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য এই ড্রাগটির প্রভাবে তার আগের দুই দশকে দেশের ৯০ শতাংশ শকুনই হারিয়ে গিয়েছে। এমনকি এর পরেও আরও দুটি পেইন-কিলারকে শকুনের জন্য বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এগুলি হল – অ্যাসিলোফেনাক এবং কেটোপ্রফেন। কিন্তু এই দুই ড্রাগ নিয়ে এখনও কোনো আইন তৈরি হয়নি। বরং আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার খুব বেশি কমেনি। ফলে নতুন এই গবেষণার পর নিমোসুলাইড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবি উঠলেও তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
পরিযায়ী পাখিদের নতুন অভয়ারণ্য দিনাজপুরে
ইতিমধ্যে অবশ্য মুম্বাইয়ের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের পরীক্ষাগারে আর একটি পরীক্ষা চলছে। সেখানে আইবুপ্রফেন এবং প্যারাসিটামলের পাশাপাশি নিমোসুলাইড কতটা নিরাপদ, তাই নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, দুই গবেষণার ফলাফল একই হবে। আর তাহলে শেষ পর্যন্ত এই ড্রাগটি নিষিদ্ধও হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে সমস্ত মানুষ, বিশেষত পশু চিকিৎসকদের। প্রয়োজনে নতুন নতুন গবেষণার ভিতর দিয়ে নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। কিন্তু বিপন্ন শকুনদের বাঁচানো আজ সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন
ইয়াসে বাস্তুহারা পাখির দল, গোসাবার পাখিরালয়ের বুকে শূন্যতা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শকুনের মৃত্যুর জন্য দায়ী সমস্ত ওষুধ নিষিদ্ধ বাংলাদেশে, পৃথিবীতে এই প্রথম