Cannes-এর দরজা ঠেলে: বিধ্বস্ত ইউক্রেন, প্রতিবাদী ক্যামেরা ও এক আতঙ্কিত মায়ের গল্প

“যুদ্ধ আসতে পারে— এমন একটা আশঙ্কা আমাদের মনে ছিলই। আমার আঠেরো বছরের মেয়ে এলিজাবেথ যেদিন আমার কাছে জানতে চাইল, ‘মা, যুদ্ধ এলে আমরা কী করব’, সেদিন ওকে বলেছিলাম, কিছু খাবার-দাবার তৈরি রাখতে হবে। যাতে প্রয়োজন হলেই পরিবার আর আমাদের বেড়ালটাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। কিন্তু মাঝরাতের বোমারু হামলার জন্য তো কেউই তৈরি থাকতে পারে না, তাই না? ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে জোর করে ঘুম ভাঙিয়ে ও যখন আমায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরটা জানায়, প্রথম দশ মিনিট হতভম্ব হয়ে ছিলাম। চারদিকে বোমার আওয়াজ, বারুদ আর পোড়া চামড়ার গন্ধ— এসব এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকে, মনে হয়, এটা সত্যি হতেই পারে না। এলিজাবেথ আমায় বলেছিল, 'মাদার, লাইফ ডিড নট প্রিপেয়ার মি ফর দিস'। আমি এ কথার কী উত্তর দেব, জানি না।”

ছলছলে চোখ, শক্ত চোয়ালে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এ-কথাগুলোই বলে যাচ্ছিলেন লারিসা গুতরাভিচ। ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে (Cannes Film Festival) ইউক্রেন প্যাভিলিয়নের (Ukraine Pavilion) প্রতিনিধি তিনি। পেশায় সিনেমা-প্রযোজক। ইউক্রেনের রাজধানী কিভ শহরেই জন্ম, কাজ, বেড়ে ওঠা। যুদ্ধ তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে ঘরছাড়া করলেও, দেশ ও দেশীয় সিনেমার প্রতি আকণ্ঠ অনুরাগে পশ্চিম ইউক্রেনেই থেকে গেছেন পরিবার সমেত। নিজেদের জগতের বন্ধুবান্ধবরা মিলেই অর্থ জোগাড় করে এ-বছরের কান উৎসবে তৈরি করেছেন দেশের প্যভিলিয়ন। অনেকটা ভরসা আর সাহায্য পেয়েছেন উৎসব কমিটির কাছেও। লারিসাদের বারংবার অনুরোধে, রাশিয়াকে এবার পুরোপুরি ব্রাত্য করেছে কান। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ছবিতে-গল্পে ‘অদেখা’ চলচ্চিত্র উৎসব

লারিসা বলে চলেছেন, “বোমারু বিমানের থেকে বাঁচতে শেল্টারে আশ্রয় নিতে পারেন আপনি, কিন্তু সৈন্যদের হাত থেকে কীভাবে বাঁচবেন? ওরা তো মানুষ নয়। চারদিকে ধর্ষণ আর অত্যাচারের গল্প শুনতে শুনতে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। আমি একা, আমার এক মেয়ে আছে, ওদের সামনে আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তাই কয়েকদিন কিভে থেকেই আমরা পালিয়ে আসি।"

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: স্ক্রিনিং থেকে প্রেস কনফারেন্স— এক সম্পূর্ণ সিনেমাযাত্রা

কান চলচিত্র উৎসবের মূল ‘প্যালে দু ফেস্টিভাল’-এর পিছন দিকেই ভূমধ্যসাগর। সমুদ্রকূলবর্তী চত্বর জুড়ে রিভিয়েরা ভিলেজ। পরপর সারি দিয়ে বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়ন। ১০৯ নম্বর রিভিয়েরা ভিলেজ ভারতীয় স্টলের ঠিকানা। সেই চত্বরে ঘুরতে-ঘুরতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একচিলতে স্টলের ভিতর #StandwithUkraine লেখা বিরাট নীল হলুদের পোস্টার। এটাই ইউক্রেনের প্যাভিলিয়ন। গতকালই প্যাভিলিয়নের ভলেন্টিয়রদের সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধির অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছিলাম। এই কথোপকথন তারই ফলশ্রুতি।

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সত্যজিৎ-জাদুতে আবারও মুগ্ধ আন্তর্জাতিক দর্শক

কথায়-কথায় এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে ইউক্রেনের প্রত্যাশা নিয়ে প্রশ্ন করি। লারা জানান, “আমরা এখানে মূলত একটাই কথা জানাতে এসেছি। যুদ্ধ দিয়ে, আগ্রাসন দিয়ে একটা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার এই অব্যবস্থা বন্ধ করতেই হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি রাশিয়ান সাহিত্য, সঙ্গীত বা সংস্কৃতির বিপক্ষে নই। ফান্ডামেন্টালি তাদের সংস্কৃতি একটা নির্দিষ্ট সমাজের কথা বলে। আর সেক্ষেত্রে সেই সংস্কৃতিই যদি এমন এক দানবের জন্ম দেয়, তবে তার প্রকাশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হওয়া উচিত।" 

এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জাতীয় পরিচিতিকে তুলে ধরার পিছনে সিনেমার ভূমিকা নিয়েও সরাসরি মন খুলে কথা বললেন ইউক্রেনের এই প্রতিনিধি। জানালেন, তাঁর বন্ধুবান্ধবরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেশের নানা জায়গায় ডকুমেন্টরি সিনেমা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গুপ্তপথে যোগাযোগ রয়েছে সকলের মধ্যেই। দেশের সরকার যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশের বন্ধুদের কাছ থেকেই ছবি তৈরির টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। দিল্লির এক বন্ধুকে ভালোবাসা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হি সেইড, অলওয়েজ রিমেমবার  ইউ হ্যাভ আ হোম ইন নিউ দেলহি।’ অন্যদিকে ২০২২ কান ফেস্টিভালে আসা বেশ কয়েকটি ইউক্রেনীয় ছবির পরিচালক এবং অভিনেতার প্রাণ ইতিমধ্যেই যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে। বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে লারিসার। বারবার বলেন, “উই, অ্যাজ অ্যান ইন্ডাস্ট্রি হ্যাজ লস্ট আ লট অফ পিপল!" জানান, যুদ্ধজয়ের পর সমস্তটা সামলে নিতে আরেকটু সময় লাগলেও, এই অযাচিত অত্যাচারের সত্যি গল্পগুলো পৃথিবীর কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবেন দেশের পরিচালক ও প্রযোজকরা। লারিসার কথায় ভেসে ওঠে আমাদের একান্ত চেনা কাজপ্রেমী মানুষের মুখ, ‘উই আর প্রফেশানালজ, উই হ্যাভ টু ওয়ার্ক!’

আমরা, ভারতীয়রা, একটা সিনেমাও কম্পিটিশন ক্যাটাগরিতে না-ওঠা সত্ত্বেও যখন প্যাভিলিয়নের নামে রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডা, খানা-পিনা, মোচ্ছবে মেতে থাকি, তখন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নাগরিকের অঙ্গীকার, স্বপ্ন, লড়াইয়ের জেদই জ্বালিয়ে রাখে ‘সিনেমা’ নামের সাংস্কৃতিক অগ্নিশিখা। ইতিহাস সাক্ষী, সিনেমা শুধুই গল্প বলে না, সে তার নিজস্ব আঙ্গিকে এক সামগ্রিক মানবিক প্রতিচ্ছবির আয়নাও হয়ে ওঠে। দেশ হিসাবে, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসাবে, এমনকি শুধুমাত্র সিনেমাপ্রেমী হিসাবেও তাই লারিসাদের লড়াই ও স্বাধীনতার স্বপ্নে সামিল হওয়াটাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব।

Powered by Froala Editor

More From Author See More