সালে বুনুয়েল প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ছে হাততালি আর উল্লাসধ্বনির আওয়াজে। কয়েক সেকেন্ড হল, বেয়ারাকে এক কাপ চা আনতে বলে বালুরঘাটের সস্তা হোটেলের বারান্দায় স্থির হয়েছে সিদ্ধার্থের চোখ। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের সাদা-কালো অবয়বে আচ্ছন্ন সকলেই। বিগত ঘণ্টা দুই যাবত এক অভাবনীয় ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছি আমি। সুদূর এই কান চলচ্চিত্র উৎসবে (Cannes Film Festival), সম্ভবত একমাত্র বাঙালি সাংবাদিক হিসেবে দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (Pratidwandi)। ডাবিং নয়, খোদ নিজের ভাষায়।
‘মার্শে দু ফিল্ম'-এ এবারের ‘কান্ট্রি অফ অনার’ ভারত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের শতবার্ষিকী উদ্যাপন। সব মিলিয়ে, ৫২ বছর পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র প্রথম প্রিন্ট পুনরুদ্ধার করে দেখানো হল এবারের ফেস্টিভালে। শুরুর আগে দর্শকের উদ্দেশ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশান অফ ইন্ডিয়া’র প্রধান রবিন্দর ভাকার। জানালেন, ভারতীয় সরকার এবং তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম সিনেমা-পুনরুদ্ধার কর্মকাণ্ড। আগামীতে ভারতের নামিদামি পরিচালকদের সমস্ত ছবিই কানে বসেই দেখতে পাবেন বিশ্ববাসী।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/2d2f5849251550f1084b0247ed116484602e922e.jpg)
কথায়-কথায় উঠে এল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র প্রসঙ্গও। রবিন্দর বলেন, ‘ছবিটা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক, তা আপনারা দেখলেই বুঝতে পারবেন। পূর্ণিমা দত্ত আমাদের ছবিটার মূল ক্যামেরা নেগেটিভগুলো দিয়ে সাহায্য করেছেন, পুনরুদ্ধারের তত্ত্বাবধানে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিগুলোকে ঠিক যে আঙ্গিকে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তেমন অবস্থাতেই আপনাদের সবার কাছে পৌছে দিতে চাই।’
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরেস্ট ওয়েটেকারের মুখোমুখি
সেসব তো আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা। এদিকে প্রেক্ষাগৃহে তিলধারণের জায়গা নেই। মূলত সাংবাদিক ও ছবি সমালোচকরাই আমন্ত্রিত, তবে সিনেমা ক্লাবগুলোর অনেক সদস্যই টিকিট কেটে এই স্পেশাল স্ক্রিনিং দেখতে এসেছেন। দর্শকাসনে প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ সিনেমাপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞরাও হাজির।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: এক সন্ধের জারি-‘জুরি’ ও ৭৫ ঘা চাবুকের ছায়া
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/e19a576fd1132c5323fcfc9b33ea28e478d31571.jpg)
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ‘ফর দ্য সেক অব পিস’— প্রথম স্ক্রিনিং, প্রথম সবকিছু
সিনেমা শুরু তো হল। ১৯৭০ সালের কলকাতা ও সমসাময়িক প্রেক্ষিত তখন পর্দায়। ক্ষণে-ক্ষণে দর্শকদের উল্লাস-প্রতিক্রিয়া। ছিড়ে-যাওয়া প্যান্ট রিফু করাতে গিয়ে রাস্তার পাশেই লুঙ্গি গায়ে সিদ্ধার্থকে দেখে অথবা ইন্টারভিউয়ের বিভিন্ন দৃশ্যে প্রশ্নকর্তাদের বোকা-বোকা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে হাসির রোল ওঠে। অন্য দিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধের অপ্রয়োজনীয়তা-প্রসঙ্গে প্রশ্নবাণের সামনেও নায়কের মতামত যে তাদের মন কেড়েছে, বোঝা গেল হাততালিতেই। নকশাল আন্দোলন, বিপ্লব ও সাধারণ মধ্যবিত্ত যাপনের অন্তর্ঘাত হোক বা ছবির অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে মূল চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত— প্রায় প্রতিটি মোড়েই আজকের দর্শককে আবারও ছুঁয়ে গেলেন সত্যজিৎ।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/7d4caa8d04c1e439c4ac162c7cd2000b5252d926.jpg)
ছবি শেষে আলাপ হল হারলন জেকবসনের সঙ্গে। মার্কিন-নিবাসী হারলন অভিজ্ঞ সিনেমা সাংবাদিক। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে কান চলচিত্র উৎসবে আসছেন। বর্তমানে আমেরিকাতে রেডিও সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত। ৫২ বছর পর নতুন অবস্থায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানালেন, ‘আমার মতে, পঞ্চাশ বছর পর ভারত তথা কলকাতার চেহারাটাও তো খানিকটা পাল্টেছে, তাই আমার মনে তা নিয়ে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এই ছবিটায় সত্যজিৎ তখনকার বেকারত্ব সমস্যা এবং তা থেকে যুবসমাজের র্যাডিকালাইজেশান পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছিলেন। ব্যাপার হল, পরিস্থিতির খানিকটা বদল হলেও বেকারত্বের সমস্যাটা এখনও প্রাসঙ্গিক বলেই আমার ধারণা।’
কয়েক বছর আগেই কেরালা এসেছিলেন হারলন। ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালও বটে। তাঁর মতে, সত্যজিতের অন্য ছবিগুলো রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি পক্ষপাতহীন। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’কে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ‘পলিটিকালি ডেটেড ডকুমেন্টারি’ হিসাবেই দেখছেন।
অন্যদিকে আমাদের সমসাময়িক রাজনীতি ও সিনেমায় সত্যজিতের প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে হারলনের উত্তরও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায়, ‘প্রশ্নটার উত্তর এই ছোট্ট পরিসরে দেওয়া একটু কঠিন। এই প্রেক্ষিতে 'ডিস্ট্যান্ট থান্ডার’(অশনি সংকেত) ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওটা একটা মাস্টারওয়ার্ক। সিনেমাটা আমাদের সবার কাছে নিজেদের মতো করে সে-সময়ের পৃথিবীর একটা ছবি তুলে ধরেছিল। আমার মনে হয়, দিস ইজ হোয়াট রে ডিড।’
হারলনের মতে, ‘অপু ট্রিলজি’র সময়কার সত্যজিৎ এক তেজি ঝকঝকে গালভানাইজিং যুবক, কিন্তু ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সেই মানুষটাই একটা 'টাইমলেস' কাজ উপহার দিয়েছেন। ‘এখানেই রে ইউনিক!’
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/83e71bba3db5b9785d15e44727ea54c02483c85b.jpg)
আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা এক তরুণ জার্মান সমালোচককে প্রশ্ন করা গেল। তাঁর নাম নিকোলাস। জানালেন, ‘ভারতের বেকারত্ব সমস্যার সঙ্গে পুরোপুরি কানেক্ট করতে না পারলেও এ-সিনেমার রাজনীতি আমাদেরও কথা বলে। ভিয়েতনামের যুদ্ধ একটা অদরকারি পদক্ষেপ— সেটা বুঝতে হলে যে কমিউনিস্ট হতে হয় না, সে-কথাটা আজও সমান সত্যি!’ (সিদ্ধার্থের চাকরির ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রসঙ্গে)
সালে বুনুয়েল থেকে বেরিয়ে কথা বলতে-বলতেই হাঁটছিলাম আমরা। হারলনদের বিদায় জানিয়ে সিঁড়ির মাঝের ধাপেই আবার পেয়ে গেলাম এন-এস-ডি-এফ অধ্যক্ষ রবিন্দর ভাকারকে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেখে দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় উৎফুল্ল রবিন্দরও। ১৯৭০ সালে তৈরি হওয়া একটা সিনেমা কীভাবে এখনও মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে, তা ভেবে বেশ খানিকটা অবাকই তিনি। নিজেই বললেন, ‘এখন সত্যজিতের সিনেমাকে, তার কাজকে বাঁচিয়ে রাখা এই যুবসমাজেরই দায়িত্ব। এ অভাবনীয়। আমরা উল্লসিত।’
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/3bff3c99e9c07ab5c874a55e7d56778c4848f6d3.jpg)
স্ক্রিনিং শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে, প্রেস ক্যাফেটায় ঢুকে স্থির হয়ে বসলাম। এই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। এই ২০২২-এ সুদূর কানে বসে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’কে ফিরে দেখার অনুভূতিই আলাদা। সত্যজিতের সিনেমায় বিদেশি দর্শকের এই উচ্ছ্বাস দেখে বাঙালি হওয়ার গর্বই-বা লুকোব কই! শুরুর আগে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে দীর্ঘ লাইন থেকে শুরু করে শেষে দর্শকের প্রতিক্রিয়া— সব দেখেশুনে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে— সত্যজিৎ সত্যিই এখনও অপরাজিত!
Powered by Froala Editor