তাজমহলের গোপন কুঠুরিতে বছরের ৩৬২ দিনই অন্ধকারে থাকেন শাহজাহান-মমতাজ!

১৬৩২ সাল। স্ত্রী মমতাজ বেগমের স্মৃতিতে যমুনার ধারে এক স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তাজমহল। প্রায় চারশো বছর পেরিয়ে এসে আজও তাজ আধুনিক বিশ্ব-স্থাপত্যের এক বিস্ময় হয়েই রয়ে গেছে। রয়ে গেছে ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক হয়ে। এই সৌধের মধ্যেই তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী-এর পাশে শায়িত রয়েছেন সম্রাট শাহজাহান (Shah Jahan)। 

তাজমহলের (Taj Mahal) প্রধান গম্বুজের কেন্দ্রে অবস্থিত এই সমাধিক্ষেত্রই অন্যতম আকর্ষণ সৌধটির। সর্বকালের কিংবদন্তি যুগলকে পাশাপাশি চিরবিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী ভিড় জমান তাজমহলে। শাহজাহানের ও মুমতাজের সেই সমাধি বা সেনোটাফ দেখার মতোই। তাজমহলের বাইরের অপার্থিব রূপও যেন হার মানে এই সেনোটাফের কাছে। শ্বেত পাথরের ওপর অমূল্য মণিমুক্তের কারুকাজ এবং খোদাই করা পাথুর নকশা রীতিমতো অবাক করে যে কাউকেই। 

তবে মজার বিষয় হল, এই দুই সেনোটাফই আদতে নকল। হ্যাঁ, সাধারণ দর্শনার্থীরা মমতাজ এবং শাহজাহানের যে কফিন দেখতে পান সারাবছর, তা বাহ্যিকভাবে মন্ত্রমুগ্ধকর হলেও, আসলে ফাঁকা। তবে শাহজাহান ও মমতাজের দেহ? 

মুঘল সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর দেখা পেতে নামতে হবে আরও ২৪ ধাপ নিচে। এই সেনোটাফ কক্ষের নিচেই এক গোপন কুঠুরিতে রয়েছে মমতাজ ও শাহজাহানের আসল সমাধি। স্থপতিদের হিসেব অনুযায়ী, তাজমহলের বাইরের বাগানের স্তরেই রয়েছে ঐতিহাসিক কফিন দুটি। যেখানে প্রবেশ করতে পারে না বাইরের পৃথিবীর কোলাহল। তুলনামূলকভাবে সেই কক্ষও বেশ আড়ম্বরহীন। শৌখিনতার ছাপ সেখানে সেভাবে নেই বললেই চলে। তবে মূল কফিনেও দেখা মিলবে কারুকাজের ঝলকানির। 

আরও পড়ুন
বাদ তাজমহল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেলুলার জেল; কোন ইতিহাস চেনাচ্ছে ইউজিসি?

প্রতিবছর নিয়ম করে মাত্র ৩ দিন খোলা হয় এই মূল সমাধিক্ষেত্রের দরজা। এই ৩ দিনই কেবলমাত্র দর্শনার্থীরা সুযোগ পান আসল সমাধি প্রত্যক্ষ করার। তবে ৩৬২ দিন সূর্যের আলো না পাওয়ায় ধীরে ধীরে বদলেছে দুটি কফিনের রং-ই। ক্রমশ কালচে হয়ে যাচ্ছে এই সমাধি দুটি। কমছে জৌলুশ। এমনকি বছর দুয়েক আগে মূল কফিনে ফাটল দেখা গেছে বলেও অভিযোগ জানান বহু দর্শনার্থী।

আরও পড়ুন
পুরুষ-সঙ্গ ছাড়াই সন্তানপ্রসব, হাঙরের কীর্তিতে তাজ্জব বিজ্ঞানীরা

তবে গোটা তাজমহল এককথায় নিখুঁত হলেও, সামান্য ‘ত্রুটি’ রয়ে গেছে মূল সমাধি কক্ষটিতেই। সেটা কেমন? আদতে শাহজাহান এই স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছিলেন কেবলমাত্র মমতাজের জন্যই। তাঁর দেহও এই সৌধতে সমাধিস্থ হবে তা চাননি তিনি। লোককথা রয়েছে, শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিল আরও একটি তাজমহল তৈরি করার। কালো মার্বেল পাথরে তৈরি সেই সৌধতেই নাকি সমাধিস্থ হতে চেয়েছিলেন তিনি। আর দুই সৌধকে জুড়তে চেয়েছিলেন শ্বেত পাথরের সেতু দিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত আর সম্ভব হয়নি তা। তার আগেই তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেন তাঁরই সন্তান ঔরঙ্গজেব। 

আরও পড়ুন
নিজে থেকেই জুড়ে যাবে ভাঙা কেলাস, বাংলার গবেষকদের আবিষ্কারে তাজ্জব বিশ্ব

তাজমহলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সর্বত্র প্রতিসাম্য। স্থাপত্য শৈলী থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম কারুকাজ— গোটা তাজমহল জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিসমতার খেলা। শুধু বাদ থেকে মূল সমাধিক্ষেত্রটি। কেবলমাত্র সম্রাজ্ঞী মমতাজকে সমাধিস্থ করার পরিকল্পনা থাকায়, মূল সমাধিকক্ষের মাঝ বরাবরই শায়িত হয়েছিল তাঁর দেহ। পরবর্তীতে শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাঁর দেহও সমাধিস্থ করা হয় মমতাজের পাশে। তবে স্থানচ্যুত করা হয়নি সম্রাজ্ঞীর দেহাবশেষ। তাজমহলের কেন্দ্রীয় অক্ষের পশ্চিমে শায়িত করা হয় শাহজাহানকে। ফলে, ছোট্ট কক্ষটিতে বিঘ্নিত হয় প্রতিসাম্যের ভারসাম্য। তাছাড়াও দুটি কফিনের নকশাতেও ফারাক চোখে পড়ার মতোই। মমতাজের কফিনে লেখা হয়েছিল আল্লাহের ৯৯টি নাম এবং কোরানের স্তবক। অন্যদিকে শাহজাহানের কফিনের উপরে খোদিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুদিন এবং ‘স্বর্গযাত্রার স্মারক’। প্রশ্ন থেকে যায় অপার্থিব তাজমহলের এই সামান্য ‘খুঁত’ কি ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং ঔরঙ্গজেব? একাধিক তত্ত্বের মাঝে আজও এই বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন ঐতিহাসিকরা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More