Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরেস্ট ওয়েটেকারের মুখোমুখি

প্রায় হুড়মুড় করেই আমার হাত থেকে মাইকটা ছিনিয়ে নেওয়ার তালে ছিলেন সিন্থিয়া। যদিও আমার কটমটে চাহনি দেখে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। সদ্য আলাপ-হওয়া অস্ট্রেলিয়া নিবাসী সাংবাদিক সিন্থিয়া। বেচারিকে দোষও দিতে পারি না। ৭৫তম কান চলচিত্র উৎসবের (Cannes Film Festival) এটাই বোধহয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রেস কনফারেন্স (Press Conference)। ঘরভর্তি সাংবাদিকদের সামনে স্টেজ আলো করে যে কিংবদন্তি মানুষটি বসে রয়েছেন, তাঁর নাম ফরেস্ট ওয়েটেকার (Forest Whitaker)।

চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? যাঁর একের পর এক নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে তৈরি করা চরিত্রগুলো দেখতে দেখতে সিনেমাকে ভালোবাসতে শিখেছে আমাদের প্রজন্ম, তাঁকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে প্রথমে বিস্ময় জাগে। এ-বছরের প্রথম স্ক্রিনিং, ডকুমেন্টারি ছবি ‘ফর দা সেক অব পিস’ ওয়েটেকার সাহেবেরই প্রযোজনা। 

‘বার্ড’, ‘প্ল্যাটুন’, ‘অ্যারাইভাল’-এর মতো একাধিক আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় ছবিতে নিবিড় অভিনয় দক্ষতা এবং তারই সঙ্গে অ্যাকাডেমি, গোল্ডেন গ্লোব ইত্যাদির মতো মহার্ঘ পুরস্কারেও এই মানুষটির পরিচয় ঢেকে থাকতে চায় না। ইউ-এন এবং নিজের তৈরি এনজিও-র সঙ্গে ফরেস্ট বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধ আক্রান্ত দেশে একনাগাড়ে কাজ করে চলেছেন। একটা সময়ে ইউনাইটেড নেশনস-এর ‘ইউনেস্কো গুডউইল অ্যাম্বাসেডর’, এবং তারও পরে ‘স্পেশাল এনভয় ফর পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ পদেও কাজ করেছিলেন। এমনকি, এ-বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার ‘পাম ডি’অর’-ও পেয়েছেন তিনি। 

শুরু হল প্রেস কনফারেন্স। পৃথিবীবিখ্যাত ফরাসি ফিল্ম সাংবাদিক এবং বৈঠকের সঞ্চালক দিদিয়ের আলুচ প্রথমেই ১৯৮৮ সালের কান চলচিত্র উৎসবে তাঁর ফরেস্টকে দেখা এবং সে-উৎসবে ওঁর ছবি কীভাবে তাঁর সাংবাদিক যাপনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সে-কথা জানান সঞ্চালক। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: এক সন্ধের জারি-‘জুরি’ ও ৭৫ ঘা চাবুকের ছায়া

কনফারেন্স আরো খানিকটা এগোয়। অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের সাংবাদিক জুটির প্রশ্নে বারবারই ঘুরে-ফিরে আসে দক্ষিণ সুদান ঘিরে ওয়েটেকারের ছবি এবং আরো নানা কর্মকাণ্ডের কথা। ছবির পরিচালনার প্রশ্নে ফরেস্ট জানান, ‘পরিচালনা আমি আর করব না, সে-কথা বলতে চাইছি না, তবে আপাতত তেমন কোনো পরিকল্পনা আমার হাতে নেই।" 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ‘ফর দ্য সেক অব পিস’— প্রথম স্ক্রিনিং, প্রথম সবকিছু

জুরি প্রেস কনফারেন্সের পরেই সিন্থিয়ার সঙ্গে আলাপ আমার। একই সঙ্গে এক্কেবারে দ্বিতীয় সারির মাঝামাঝি এসে বসেছি আমরা। তারই মধ্যে আমরা দুজন সঞ্চালকের পাশেই দাঁড়ানো কর্মব্যস্ত মহিলাটিকে চোখের ইশারায় কাকুতি-মিনতি করে অনুরোধ জানিয়েছি। ঠিক সাড়ে এগারো মিনিটের মাথায় শিকে ছিঁড়ল। হাতে মাইক নিয়ে, নিজের ভিতরের কাঁপুনিকে কোনোক্রমে চাপা দিয়ে এবং তারই সঙ্গে সিন্থিয়ার গড়গড়ানিকে পাত্তা না দিয়েই সরাসরি প্রশ্ন করে বসলাম ফরেস্ট ওয়েটেকারকে। পৃথিবীর তথাকথিত পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোতে ছবি তৈরি এবং সে-ছবি বা গল্পকে প্রান্তিক মানুষের কাছে আবারও ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখানোর বা এ্যাক্সেসিবিলিটি এ্যাপ্রোচ সম্পর্কে। উঠে এল ‘দা লাস্ট কিং অফ স্কটল্যান্ড’ এবং ‘ফর দা সেক অব পিস’ ছবিদুটির প্রসঙ্গও। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সোমবারের দুপুর, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও সত্যজিৎ-ছায়া

ফরেস্ট জানান, ‘আমি দশ বছর ধরে একটা এনজিও চালাই, আর তার পাশাপাশি দক্ষিণ সুদানের উপরই কাজ করে চলেছি। আমি চেয়েছি ওখানকার যুবসমাজের কথা আর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের গল্প উঠে আসুক। কাজেই পোস্ট কার্ড লটারির মাধ্যমে ক্রাউড ফান্ডিং শুরু করি আমরা। সে-টাকাতেই এই ছবিটা তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় ছবিটা সম্বন্ধেও কিছু কথা হওয়া প্রয়োজন।’

স্টেজে ডেকে নেওয়া হল ‘ফর দা সেক অব পিস’ ছবির দুই পরিচালককে। আলাপও হল সকলের সঙ্গে। তাঁদের দিকে মাইক বাড়িয়ে দেওয়ার আগে ফরেস্ট বলেন, ‘ছবি তৈরির জন্য যা যা তথ্য প্রয়োজন, আমরা সেসব জোগাড় করেছি আস্তে আস্তে। আর এঁরা ছবিটা যত্ন সহকারে ছ-বছর ধরে বানিয়েছেন।’ 

এ-কথারই ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টফ(পরিচালক) বলেন, ‘আমরা শুরুতে মূলত পিস-মেকারদের পোট্রেট তোলার কাজই করছিলাম। ফরেস্টের এনজিও ওদের মেক্সিকো, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনই নানা জায়গায় ট্রেনিং দিয়েছিল। কাজটা করতে করতে আমরা বুঝতে পারি, এই সুন্দর মানুষগুলো যারা শান্তির কথা ছড়িয়ে দিতে চাইছে, তাদের গল্প সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তো একটা গোটা ডকুমেন্টারিই বানাতে পারি! ফলে এই গোটা কাজটাই আমাদের জন্য একটা অপূর্ব সুযোগ। আমরা ভেবেছিলাম, কাজটা করতে আমাদের এক কিংবা দু-বছর লাগবে। কিন্তু আদপে ছ-বছরের দীর্ঘ অ্যাডভেঞ্চার হয়ে দাঁড়ায়!’

পাশাপাশি, অপর পরিচালক থমাস জানান, ‘কাজটার পিছনে আমরা লেগে থেকেছি, আর সেটা খুব সহজ ছিল না! এক একটা সময়ে ছবির কাজ এমন কি আমাদের জীবনও বিপন্ন হয়েছে!’ 

এর পর কনফারেন্সের ধারা মাঝে মধ্যে রাস্তা পাল্টালেও কথায় কথায় আবারও সেই এ্যাক্সেসিবিলিটির প্রশ্নেই ফিরে আসে। খ্রিস্টফ আবারও জানান, ‘কাজের সময় আমরা মানুষগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছি। নানদেগে আজ এখানে থাকলে ভালো হত। ওরা সকলেই জানে, ওদের ওপর তৈরি ছবি কান উৎসবে দেখানো হচ্ছে। ওদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের ফেসবুক ওয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।’ 

প্রেস কনফারেন্স শেষ। একটিবারের দশ মিনিটের মুখোমুখি কথাই স্মরণীয় হয়ে রইল আমার কাছে। পাশাপাশি, ঠিক মঞ্চে ঠিক প্রশ্নের প্রয়োজনীয়তাটা নিজে হাতে শিখিয়ে গেলেন ওয়েটেকারও। এই চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতি বাঁকে এত নতুন অভিজ্ঞতা লুকিয়ে, থই পাওয়া যায় না। সেসবের মধ্যেও এই কথোপকথন অমূল্য। ধন্যবাদ, ফরেস্ট!

Powered by Froala Editor

More From Author See More