পেশায় চা বিক্রেতা, লিখেছেন ২৫টি বই; অনুপ্রেরণার অন্য নাম লক্ষ্মণ রাও

হাতে যত্ন করে লেখা পাণ্ডুলিপি। অনেক স্বপ্ন নিয়েই পৌঁছেছিলেন প্রকাশকের কাছে। কিন্তু তা খুলেও দেখেননি প্রকাশক। বরং পোশাকের দিকে তাকিয়েই বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। অথচ তাঁকে যে লেখক হতেই হবে। তাই অপেক্ষা করেননি আর প্রকাশকের জন্য। নিজেই খুলেছিলেন নিজের প্রকাশনা সংস্থা। সেখান থেকেই প্রকাশ করে গেছেন একের পর এক বই। 

লক্ষ্মণ রাও। দিল্লির হিন্দি ভবন আইওটির বাইরেই ছোট্ট চায়ের দোকান তাঁর। সারাদিন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানেই। রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়িতে নিজেই তৈরি করছেন চা। নিজেই তা এগিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতাদের থেকে। তাঁদের সঙ্গেই জমে উঠছে আড্ডা, গল্প। দোকান থেকে রাতে বাড়ি ফিরে সেসবই খাতায়-কলমে বন্দি করেন তিনি। জীবন-জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে যুদ্ধ করেই যেন বাঁচিয়ে রাখা স্বপ্নকে। তরুণ লেখকদের কাছে তিনিই এখন অনুপ্রেরণার মূর্ত প্রতীক।

বর্তমানে দিল্লির বাসিন্দা হলেও লক্ষ্মণ রাওয়ের জন্ম মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর ছোট্ট একটি গ্রামে। ১৯৫২ সালে। ১৯৭৫ সালে লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সেখান থেকেই তিনি চলে এসেছিলেন দিল্লিতে। ভেবেছিলেন রাজধানীতে এসে কলজে পড়াশোনা করবেন হিন্দি সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু নতুন শহরে এসে প্রকট আর্থিক সংকট। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী অবধি। দেশের রাজধানীতে এই যোগ্যতা দেখে কে-ই বা চাকরি দেবে তাঁকে? শেষ অবধি কাজ নিলেন একটি ধাবায়। পরিচারকের চাকরি। সেখান থেকে উঠে এসে একসময় পানের দোকানও চালিয়েছেন তিনি। তবে এসবের পিছনে থেমে থাকেনি সাহিত্যচর্চা। 

এখনও অবধি মোট ২৫টি বই লিখেছেন তিনি। উল্লেখ্য, এর মধ্যে ১৮টি বইয়ের প্রকাশনা করেছেন তিনি নিজেই। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রবন্ধ থেকে শুরু করে উপন্যাস, সবই। তাঁর লেখা ‘দানস’, ‘রেণু’, ‘রামদাস’, ‘নর্মদা’ প্রভৃতি বই যথেষ্ট জনপ্রিয় দিল্লি তথা সারা দেশের পাঠকমহলের কাছে। তবে এই সমস্ত বইয়ের বিষয় বস্তু কিন্তু মনগড়া নয়। তা অভিজ্ঞতা-লব্ধ। দোকানে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেই তিনি তুলে এনেছেন উপন্যাসের গল্পদের। বাস্তব চরিত্রদের বসিয়েছেন দুই মলাটের মাঝে। ফিকশনের থেকেও জীবনের গল্পতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন লেখক লক্ষ্মণ রাও।

প্রকাশকের থেকে ফিরে এসে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন বছর খানেক। মাঝের সময়টায় ছিল কঠোর পরিশ্রমের। তারপর টাকা জমিয়ে নিজেই প্রকাশ করলেন নিজের বই। সময়টা ১৯৭৯ সাল। কিন্তু কীভাবে মানুষ জানবে এই বইয়ের ব্যাপারে? কীভাবেই বা পাঠকের কাছে পৌঁছাবেন তিনি? সাইকেলে করে বই নিয়েই ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা শুরু করলেন। তবে নিজেই অবাক হয়েছিলেন ফলাফল দেখে। বহু মানুষই হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর লেখা বই। 

যতদিন গেছে তত নিজেকে প্রযুক্তির সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েছেন লক্ষ্মণ রাও। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে হিন্দি সাহিত্যে স্নাতক করেছেন ৫০ বছর বয়সে। তারপর স্নাতকোত্তর ৬৪ বছরে এসে। শিক্ষাব্যবস্থার বয়সসীমার সমস্ত জালই ভেঙে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি কিন্ডেলেও পাওয়া যায় তাঁর লেখা গ্রন্থ। সেই সঙ্গে তাঁর বই বিক্রি হয় অনলাইনে আমজনের মতো সাইটেও। 

আরও পড়ুন
পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী, বাংলার প্রথম রূপান্তরকামী হিসেবে করোনাকে হারালেন জিয়া

বর্তমানে শুধু লেখাই নয়, লেখক তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছেন লক্ষ্মণ রাও। করিয়ে চলেছেন একের পর এক কর্মশালা, রুটিন মাফিক ক্লাস। শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালে। অক্সফোর্ড বইবিপণীর ডাকেই তিনি প্রথম অংশ নিয়েছিলেন একটি কর্মশালায়। বলাই বাহুল্য, জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তারপর থেকে একের পর এক জায়গা থেকেই ডাক আসতে থাকে। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার মানুষরাই এখন লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছেন তাঁর কাছে। 

যদিও লেখকের থেকে একজন মেন্টর হওয়া অনেক কঠিন বলেই নিজে মনে করেন লক্ষ্মণবাবু। কর্মশালায় মূলত মানুষের জীবনের গল্প কীভাবে তুলে আনতে হয়, তা-ই মূলত হাতে ধরে শেখান তিনি। সেইসঙ্গে স্ব-প্রকাশনার খুঁটিনাটিও। নিজের বই কীভাবে প্রকাশ করা যায় প্রকাশকের ওপর নির্ভর না করে, সে ব্যাপারে হাতে ধরেই শেখাচ্ছেন তিনি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস বইয়ের মাণের ওপরেই বিচার করেন পাঠক। প্রকাশনা সংস্থার ওপরে নয়।

এসবের বাইরে বিভিন্ন স্কুল কলেজেও আমন্ত্রিত হন তিনি। অনুপ্রেরণা মূলক বক্তৃতার জন্য। কিন্তু নিজে কখনো কোনো অর্থের দাবি করেন না লক্ষ্মণবাবু। যেটুকু সাম্মানিক তাঁরা এগিয়ে দেয় সেটুকুই। 

আরও পড়ুন
আমফান দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে ডাক্তারির পেশায় ফিরলেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

লেখক হিসাবে পরিচিত হতে পেরেছেন তিনি। নেই অর্থাভাবও। তবুও ৬৮ বছর বয়সে আজও চালিয়ে যাচ্ছেন চায়ের দোকান। পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রোদ-জল মাথায় করেই। কারণ? এই দোকানই তাঁর গল্প আহরণ ক্ষেত্র। এই দোকানই তাঁর কাছে একটি প্ল্যাটফর্ম সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কাজেই শেষ দিন অবধিই এই দোকান চালিয়ে যেতে চান দিল্লির প্রৌঢ় লেখক। এই লড়াই, এই মনোভাব অনুপ্রেরণাদায়ক বললেও কম বলাহয় হয়তো...

তথ্যসূত্র-
১. Passionate literary journey of a Tea Stall Author: Laxman Rao, TEDx Talk, Youtube.com
২. Award-Winning 67-YO Delhi Chai Seller has Written 25 Books, Sanjana Santhosh, Sold 30,000 Copies, The Better India
৩. Life of a tea- seller as a writing coach in Delhi, Manoj Sharma, Hindustan Times
৪. উইকিপিডিয়া

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পেশায় শ্রমিক, মাটি কাটছেন ভরদুপুরে, বিকল্প জীবিকার আর্জি ভাইরাল ‘চা-কাকু’র

More From Author See More