আমাজন নদীর উপর নেই কোনো সেতু, কেন?

বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী আমাজন (Amazon)। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে যার তুলনা চলতে পারে একমাত্র নীল নদীর সঙ্গে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়ার উপর দিয়ে বয়ে গেছে আমাজন। প্রায় তিন কোটি মানুষের বসবাস তীরবর্তী অঞ্চলে। অসংখ্য জনজাতির বাস। জীববৈচিত্র্যেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই দীর্ঘ অঞ্চল। অথচ, এর উপর আজ পর্যন্ত নির্মিত হয়নি কোনো সেতু। আশ্চর্যের হলেও সত্যি। ৬৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর বুকে খোঁজ মিলবে না কোনো সেতুর। কিন্তু কী এর কারণ? শুধুই কি পৃথিবীর বৃহত্তম বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যের (Rain Forest) প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য? নাকি জড়িয়ে আছে অন্য কোনো বিষয়? 

তার উত্তর পেতে হলে আমাদের তাকাতে হবে আমাজন নদীর ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা আমাজনের জলপ্রবাহ। এখানে মূলত জুন থেকে নভেম্বর মাসে বিরাজ করে বর্ষা ঋতু। বৃষ্টির জলে বন্যার মুখোমুখি হয় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি। দৈর্ঘ্যে বিরাট আকৃতির হলেও আমাজন নদীর একটি বড়ো অংশ মূলত অরণ্যের মধ্যে। মোটামুটি সাড়ে তিন কিলোমিটার থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে এর স্বাভাবিক প্রস্থ। কিন্তু কোনো কোনো অঞ্চলে বর্ষাকালে তা দাঁড়ায় ৪৮ কিলোমিটার। জলের গতিবেগ তখন প্রতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার। এই পরিস্থিতিতে সেতু তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করাই প্রায় অসম্ভব।

তবে সব জায়গার অবস্থা তো এরকম নয়। যেখানে বন্যার ভ্রূকুটি নেই, সেখানে তো অনায়াসে সেতু তৈরি করা যেতে পারত। সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং আমাজন। কারণ এর দু’পারের মাটি অত্যন্ত নরম। যেখানে কোনোভাবেই সেতুর বুনিয়াদি পরিকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কাঠের সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা যে হয়নি, তা নয়। তবে সেখানেও সমস্যা আমাজনের খামখেয়ালি আচরণ। নদীর জলস্তরের হ্রাস-বৃদ্ধি এতোটাই অনিয়ন্ত্রিত যে, এই পরিকল্পনাও বাতিলের খাতায় ফেলতে হয়েছে।

'সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ইঞ্জিনিয়ার ওয়াল্টার কউফম্যান নির্দেশ করছেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার দিকে। শুধু দৈর্ঘ্য নয়, আমাজনের মূল গুরুত্ব তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য। যাকে বলা হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। কয়েক লক্ষ প্রাণী ও গাছপালার সুখশান্তির ঠিকানা এখানে। যা ইতিমধ্যেই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য। অরণ্য ধ্বংস করে চলছে নগরায়ণ। মাটির নিচের খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য উদ্বাস্তু হতে হয়েছে বহু মানুষ ও প্রাণীদের। উষ্ণায়নের জেরে মৃত্যুর মুখে বিরল ডলফিন প্রজাতিরা। এই অবস্থায় সেতু নির্মাণের কাজ আরো বড়ো সমস্যা ডেকে আনতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রেও কেটে ফেলা হবে বিরাট অঞ্চলের গাছপালা। নিশ্চিতভাবেই বিনষ্ট হবে আমাজনের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য।

আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য গোলাপি ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার, আমাজনে অব্যাহত মৃত্যুমিছিল

২০১৯ সালে ব্রাজিল সরকার আমাজনের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর দিয়ে ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি হাইওয়ের পরিকল্পনা নিয়ে আসে। পরিবেশকর্মী ও সাধারণ মানুষের আন্দোলনে অবশ্য তা বাস্তবরূপ পায়নি। অবশ্য আরেকটা কারণ এটা হতে পারে যে, আমাজনের উপর সেতু নির্মাণ আদৌ লাভজনক নয়। এর একটি বড়ো অংশ অরণ্য আচ্ছাদিত। জনবসতির মধ্যে থাকা অঞ্চলে মূল পরিবহণের কাজ করে নৌকো বা ছোটো জাহাজ। এভাবেই চলে এসেছে দিনের পর দিন। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার সঙ্গে। ফলে নতুন কোনো পরিকল্পনা আর গ্রহণ করা হয়নি।

আরও পড়ুন
শুধু চোরাচালানই নয়, আমাজন ধ্বংসের পিছনে দায়ী অসংখ্য কারণ

একমাত্র আমাজনের উপনদী নেগ্রো নদীর উপরেই রয়েছে একটি সেতু। ২০১১ সালে নির্মিত সেতুটির নাম পন্টে রিও নেগ্রো। মূলত ব্রাজিলের ইরানডুবা ও মানাউস শহর দুটিকে সংযুক্ত করার কাজ এই সেতুটির। এছাড়া আমাজনের উপরে আর কোনো সেতুর অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতে কী হবে বলা যায় না। তবে বৃহত্তর পরিকল্পনা যে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে আরেকবার রক্তচক্ষু দেখাবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

Powered by Froala Editor