অবৈধ খনন, বৃক্ষচ্ছেদনের বিরুদ্ধে লড়ে ‘গোল্ডম্যান’-জয় আমাজনের আদিবাসী মহিলার

আমাজনের শাখানদী টাপাজোসের অববাহিকা। গভীর অরণ্য। চতুর্দিক মুখরিত হয়ে রয়েছে পাখির কোলাহলে। ব্রাজিলের পারা এবং মাতো গ্রসো প্রদেশে অবস্থিত এই অরণ্যই যুগ যুগ ধরে আশ্রয় জুগিয়ে আসছে মুন্ডুরুকু উপজাতির মানুষদের। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে ‘সভ্য’ মানুষের তাণ্ডবে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে তাঁদের। নিরন্তর অরণ্য-নিধনে কেউ কেউ হারিয়েছেন ভিটেমাটি। অরণ্য জুড়ে কমেছে শিকার। তাছাড়া অনৈতিক খননের জন্য দূষণের জেরে ক্রমশ বেড়ে চলেছে দুরারোগ্য নানা রোগের প্রকোপ।

নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতেই তাই শেষ পর্যন্ত তাই গণ-আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হন মুন্ডুরুকুরা। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বছর তিরিশেকের এক তরুণী। আলেজান্দ্রা কোরাপ মুন্ডুরুকু (Alessandra Korap Munduruku)। প্রকৃতি বাঁচানোয় অনস্বীকার্য অবদানের জন্য এবার গোল্ডম্যান পুরস্কার (Goldman Prize) পেলেন ব্রাজিলের এই আদিবাসী তরুণী। 

বর্তমানে সবমিলিয়ে মুন্ডুরুকুদের সংখ্যাটা ১৪ হাজার। তবে ক্রমশ কমছে এই জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষা। অরণ্যের অধিকার হারানোর ফলে বাধ্য হয়ে আমাজন ছেড়ে শহরে গিয়ে বাসা বাঁধছেন মুন্ডুরুকুরা। আলেজান্দ্রার ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। শিক্ষাগ্রহণের জন্য শহরাঞ্চলে পাড়ি দেন আলেজান্দ্রা। বিষয় ছিল পরিবেশ। চাকরিও জুটে গিয়েছিল। তবে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ফের জন্মভূমিতেই ফিরে আসেন তিনি। বরং, স্থানীয় আদিবাসী মহিলাদের শিক্ষিত করে তোলার ভার নেন। তাঁদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে শুরু করেন গণ-আন্দোলন। 

২০০৭-০৮ সাল সেটা। ব্রাজিলের মসনদে তখন লুলা ডা সিলভা। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশকে মজবুত করতে অরণ্যনিধনের ওপর অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা ও আইন শিথিল করে দেন তিনি। তারপরই শুরু হয় আলেজান্দ্রার আইনি লড়াই। ‘কোয়ালিশন অফ ইনডিজেনাস পিপলস অফ ব্রাজিল’ এবং ‘অ্যামাজন ওয়াচ এবং গ্রিনপিস’-এর মতো সংস্থার কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন আলেজান্দ্রা। সেইসঙ্গে অরণ্য সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। পরবর্তীতে ব্রাজিলের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেও বদলায়নি অবস্থান। বরং, জের বলসোনারোর মতো রাষ্ট্রপতি একাধিক বিদেশি সংস্থাকে সুযোগ করে দেন অবৈধ খননের জন্য।  

না, তাৎক্ষনিকভাবে কোনো ফলাফল পাননি তিনি। পাননি রাজনৈতিক সহায়তাও। তাই বিকল্প হিসাবে অবৈধ খনন রুখতে বেছে নিয়েছিলেন প্রযুক্তিকে। আমাজনের বহু দুর্গম অঞ্চলে, অরণ্যের মধ্যেই স্থাপন করেছিলেন সিসিটিভি ক্যামেরা। সেইসঙ্গে ব্যবহার শুরু করেন ড্রোনের। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে অনুপ্রবেশকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাদের এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছবি তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে। যা ঘৃতাহুতি দিয়েছিল বৃহত্তর আন্দোলনে। এমনকি গ্লাসগোয় আয়োজিত কপ-২৬ সম্মেলনেও রীতিমতো ঝড় তুলেছিল মুন্ডুরুকুদের কণ্ঠস্বর।

হ্যাঁ, তার ফলাফলও পেয়েছেন তাঁরা। ২০১৯ সালে ব্রাজিল সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত ২৭টি খনি বন্ধ করতে বাধ্য হয় ন্যাশনাল মাইনিং এজেন্সি। আমাজন অববাহিকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় একাধিক মার্কিন ও ইউরোপীয় সংস্থা। সেইসঙ্গে মুন্ডুরুকু সম্প্রদায়ের মানুষদের নজরদারি ও পাহারায় বিগত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে কমেছে অবৈধ অরণ্যনিধন ও লগিং-এর মাত্রা। অবশ্য এই আন্দোলনের পথ যে খুব সহজ ছিল, তা একেবারেই নয়। একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি এসেছে আলেজান্দ্রার কাছে। ক্লান্ত হয়ে বার বার ফিরে আসতে হয়েছে প্রশাসনের দরজা থেকেও। তবে হার মানেননি তিনি। আলেজান্দ্রার এই লড়াই কুর্নিশযোগ্য তো বটেই। আর সেই কারণেই হয়তো পরিবেশবিদ্যার জগতে অন্যতম খেতাব ‘গোল্ডম্যান পুরস্কার’-এর পালক জুড়ল ৩৯ বছর বয়সি আলেজান্দ্রার মুকুটে। 

Powered by Froala Editor