শুধু চোরাচালানই নয়, আমাজন ধ্বংসের পিছনে দায়ী অসংখ্য কারণ

ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস। প্রতিনিয়ত কাটা পড়ছে হাজার হাজার গাছ। বিশ্বের অন্যতম কার্বন সিঙ্ক অ্যামাজনকে নিয়ে এ-ধরনের খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নজরে আসে হামেশাই। অথচ, আমাজন (Amazon) অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলির সরকারের তরফে বার বার দাবি উঠেছে আমাজন সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু সত্যিই কি বাস্তবে ফলপ্রসূ হচ্ছে সেই পদক্ষেপ?

সমীক্ষায় উঠে আসছে ভিন্ন তথ্য। প্রথমে নজর রাখা যাক ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। তদন্তমূলক এই সমীক্ষার দাবি অনুযায়ী, বিগত ৬ বছর আমাজন-জুড়ে কাটা পড়েছে সবমিলিয়ে ৮০ কোটি গাছ। কিন্তু কী কী কারণে বৃক্ষনিধন করা হয়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে? নাসার প্রাক্তন মহাকাশ গবেষক, ভূতত্ত্ববিদ এবং অধ্যাপক টিমোথি লরেন্স কিলেনের গবেষণায় উঠে আসছে একাধিক পৃথক পৃথক কারণ। এমনকি বননিধনের কারণের প্রেক্ষিতে আমাজনের মানচিত্রও প্রস্তুত করেছেন তিনি। তুলে ধরেছেন বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে আমাজনের বদলে যাওয়া ভূপ্রাকৃতিক ছবি। 

অধিকাংশ মানুষের কাছেই আমাজন বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্রাজিলের গহীন অরণ্যের ছবি। অথচ, বৃহত্তর আমাজন বা প্যান আমাজনের মধ্যে শুধু ব্রাজিল নয়, রয়েছে সবমিলিয়ে ৯টি রাষ্ট্র। যার মধ্যে রয়েছে বলিভিয়া, ব্রাজিল, কলোম্বিয়া, ইক্যুয়েডর, গিয়ানা, ফ্রেঞ্চ গিয়ানা, পেরু, সুরিনাম এবং ভেনেজুয়েলা। সবমিলিয়ে এই সমগ্র বনভূমির বিস্তৃতি প্রায় ৮২.৫ কোটি হেক্টর। ২০১৮ থেকে ২০২১— এই তিন বছরের মধ্যেই হারিয়ে গেছে এই বিপুল বনভূমির ১৩ শতাংশ অঞ্চল। যার আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি হেক্টর। সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে সেখানকার পরিবেশগত পরিস্থিতি এবং ভূপ্রকৃতি। 

এবার নজর দেওয়া যাক অরণ্যনিধনের কারণগুলির দিকে। কোকা চাষ, পশুপালন, অবৈধ খনন, কাঠ সংগ্রহ, ঝুমচাষ, সভ্যতার বিকাশ এবং সর্বোপরি দাবানল— স্বাভাবিকভাবে আমাজনের মূল ঘাতক হিসাবে ধরে নেওয়া হয় এগুলিকেই। তবে আমাজন অন্তর্ভুক্ত লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশেই যে এই প্রতিটি ঘটনা লক্ষ করা যায়, এমনটা নয়। 

কিলেন মূল প্যান-আমাজনকে ভাগ করে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি পৃথক অঞ্চলে। যার মধ্যে সুরিনাম, গিয়ানা, ফ্রেন্স গিয়ানা এবং ভেনেজুয়েলার কিছু অংশ নিয়ে তৈরি গিয়ানা আমাজনে সবচেয়ে বেশি অরণ্যনিধন হয়ে চলেছে ‘গোল্ড রাশ’ বা অবৈধ স্বর্ণখননের কারণে। অবশ্য শুধু এই অঞ্চলই নয়, ব্রাজিলের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত ‘আমাজন করিডর’-এও অবৈধ স্বর্ণখননের প্রাবল্য দেখা যায়। 

অন্যদিকে ব্রাজিলের অন্তর্গত দক্ষিণ আমাজনিয়া এবং পশ্চিমে পেরু ও ইকুয়েডরে অরণ্য নিধনের কারণ হয়ে উঠেছে সভ্যতার বিকাশ। একদিকে ব্রাজিলে যেমন নগরায়ণ ক্রমশ দক্ষিণ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তরে, তেমনই পেরু ও ইকুয়েডরে আমাজন অরণ্যের মধ্যে গড়ে উঠছে একের পর এক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। কাটা পড়ছে গাছ। সেইসঙ্গে কংক্রিটের আচ্ছাদনে মুড়ে ফেলা জমিতে নতুন করে অরণ্য তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে চিরতরে। আমাজন ও তার নানা শাখানদী-উপনদীর ওপরে বাঁধ তৈরির ফলে বদলাচ্ছে জলপ্রবাহ এবং উপত্যকার বাস্তুতন্ত্রও। 

আবার আন্দিজ পর্বত সংলগ্ন অঞ্চলে আমাজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোকা চাষের ফলে। মধ্য আমাজন বা আমাজনের মূল অববাহিকায় বাড়ছে ঝুমচাষের প্রবণতা এবং পশুপালন। গবেষণা অনুযায়ী, এই কটি কারণের জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার বর্গমাইল বন সাফ করে ফেলা হচ্ছে আমাজনে। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক বড়ো বড়ো মাফিয়াচক্র। লাতিন আমেরিকায় কোকার মূল সরবরাহকারী রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম নাম পেরু। পাশাপাশি ব্রাজিলের মধ্য আমাজন থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন ভেড়ার মাংস সরবরাহ করা হয় গোটা বিশ্বে। এই ভেড়া পালনের জন্যই আস্ত বনভূমিকে চারণভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়। এমনকি আমাজনে বার বার অগ্নিকাণ্ড বা দাবানলের প্রকোপও বাড়ছে এই ঘটনার জেরেই। 

কিলেনের এই অভিনব মানচিত্র শুধু আমাজনের বদলে যাওয়া ভূপ্রকৃতির ছবিই তুলে ধরে না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বনভূমি রক্ষার জন্য বিভিন্ন আমাজনিয়ান দেশে পৃথক পৃথকভাবে বনভূমি সংরক্ষণ আইনে বদল আনার প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র কাঠের চোরাচালান আটকে আমাজন সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। 

Powered by Froala Editor