বেলুন নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা! নেপথ্যে একটি গুজব

১৮৬৪ সাল। এরোপ্লেন আবিষ্কার হতে তখন বছর চল্লিশ বাকি। মানুষের আকাশে ওড়ার উপায় বলতে একমাত্র বেলুন। বিরাটাকৃতির গ্যাস বেলুনে চড়ে দিব্যি অনেকেই পাড়ি দেয় আকাশে। পরিবহণ হিসেবে হয়তো গ্রহণযোগ্য নয়, আসলে সাধারণ জনতাকে তাক লাগিয়ে দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আর সত্যিই লোকে অবাক হত। হাজার-হাজার মানুষ ভিড় করে দেখত কোনো দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর আকাশভ্রমণের দৃশ্য। সেইসব গগনচারীর সংখ্যা কম হলেও, তাঁরা তখন রীতিমতো সেলিব্রিটি। সেরকমই এক প্রদর্শনীতে ইংল্যান্ডে লেগে গেল দাঙ্গা (Balloon Riot)। নেপথ্যে বেলুন সংক্রান্ত একটি ছোট্টো গুজব। 

তার আগে বলে নেওয়া দরকার হেনরি ট্রেসি কক্সওয়েলের (Henry Tracey Coxwell) কথা। কারণ, তাঁর তৈরি বেলুন নিয়েই যত গণ্ডগোল। ১৮৬২ সালে ‘ব্যোমযাত্রী’ কক্সওয়েল ও আবহাওয়াবিদ জেমস গ্লেইসার একটি ঐতিহাসিক সফর করেন। প্রায় ৩৫০০০ ফুট উঁচুতে উঠে যায় তাঁদের বেলুন। ক্রমশ তাঁরা বুঝতে পারেন অক্সিজেনের অভাব। প্রবল ঠান্ডায় একেবারে নিঃসাড় হয়ে যায় হাত-পা। একটা সময়ে অজ্ঞান হয়ে যান জেমস। কিন্তু সেবার কক্সওয়েলের বুদ্ধিমত্তার জন্য কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তাঁরা। হাতে কোনো শক্তি না পেলেও দাঁতের সাহায্যে বেলুনটিকে পরিচালনা করতে শুরু করেন তিনি। বীরের পূজা চলে সর্বত্র। মাটিতে নামতেই একেবারে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ হয়ে ওঠেন কক্সওয়েল। সঙ্গীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য নয়, এক নতুন অভিযানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। 

ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ বাড়তে থাকে কক্সওয়েলের পরবর্তী অভিযান নিয়ে। এবার নতুন কী চমক দেবেন তিনি? চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অসংখ্য গুজব। কোথাও শোনা যায়, এবার তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বেলুন বানিয়ে পাড়ি দেবেন। কেউ-বা বলেন, নিশ্চয়ই গতবারের থেকে বেশি উচ্চতায় যাবেন কক্সওয়েল। অবশেষে এল ১৮৬৪ সাল। ‘ব্রিটানিয়া’ নামের নতুন বেলুন নিয়ে প্রস্তুত কক্সওয়েল। ক্রিস্টাল প্যালেস আর ডার্বিতে প্রাথমিক পরীক্ষার পালাও সমাপ্ত হল। এবার জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনী। দিন ঠিক হল ১১ জুলাই। ঠিকানা লেস্টার শহরের ভিক্টোরিয়া পার্ক। 

প্রদর্শনীর কদিন আগে থেকেই প্রবল উৎসাহে ফুটছে লেস্টারের জনতা। এর আগে তারা বেলুনে পাড়ি দেওয়া দেখেছে। কিন্তু ‘কিংবদন্তি’ কক্সওয়েলের কর্মকাণ্ড প্রথমবার চাক্ষুষ করার সুযোগ এসেছে তাদের সামনে। নিশ্চয়ই অতিমানবিক কিছু ঘটতে চলেছে। রাস্তা-ঘাটে শুধু একটাই আলোচনা। প্রত্যাশার পারদ আর গুজবের পরিমাণ বেড়ে চলল দিনকে দিন। প্রদর্শনীর ঠিক দুদিন আগে ছড়িয়ে পড়ল একটি গুজব। কক্সওয়েল নতুন কোনো বেলুন আনছেন না। এটা তাঁর পুরনো একটি মডেল। প্রদর্শনীর দিন মাঠে জড়ো হয়েছিল প্রায় ৫০০০০ মানুষ। বেলুনটি যে আকারে বড়ো, সেটা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করল। কিন্তু তারা তো জানত, কক্সওয়েল আরো বড়ো বেলুন তৈরির জন্য বিখ্যাত। 

আরও পড়ুন
মাটিতে নয়, বেলুনে উড়ে হয়েছিল যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ

ব্যাস, ছাই চাপা গুজবের আগুনে ঘি পড়ল। তাহলে সত্যিই তাদের ফাঁকি দিচ্ছেন কক্সওয়েল। জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তীব্র ক্ষোভ। এদিকে কক্সওয়েল বারোজন শহরবাসীকে বেলুন ভ্রমণের জন্য বিশাল দামের টিকিট বিক্রি করেছিলেন। তারা বেলুনের সামনে আসতেই জনতাকে আটকানো আর সম্ভব হল না। নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি থেকে ক্রমে আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন কক্সওয়েল ও তাঁর বেলুন। পুলিশের আগমন ঘটনাকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। লাঠিচার্জে একজন মহিলা জখম হলে সমগ্র তল্লাট জুড়ে শুরু হয় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা। যার জের সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় ‘ব্রিটানিয়া’-কে। পুরো বেলুনটি ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে আগুন লাগিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। সামান্য চোট-আঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান কক্সওয়েল।

আরও পড়ুন
বিশ্বের প্রথম মহিলা বেলুনচালক সোফি, রোমাঞ্চকর জীবন ফুরিয়েছিল ট্র্যাজেডিতেই

জনতা-পুলিশে লড়াই থামল পরদিন। তারপর শুরু হল দোষারোপের পালা। কক্সওয়েল দায়ী করলেন স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে। কর্তৃপক্ষ দায়ী করল বহিরাগতদের। বাইরের পত্রপত্রিকায় লেস্টারের সাধারণ মানুষকে বলা হল হিংস্র ও বর্বর। ততক্ষণে যা গণ্ডগোল হওয়ার হয়ে গেছে। বেলুন ওড়ানো নিয়ে একটা সামান্য গুজবের জের এতদূর পৌঁছোতে পারে, তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অবশ্য কল্পনা যে বাস্তবে কত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, তা শুধু লেস্টার নয়, সারা বিশ্বই বিভিন্ন সময়ে দেখেছে। ‘গুজব’ পরিণত হয়েছে ‘ফেক নিউজ’-এ। কানে কানে বলা কথা ছড়িয়ে পড়েছে ফোনে-ফোনে। সত্যি-মিথ্যা বিচার না করে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ তো আমাদের আশেপাশেও কম নেই। গুজবের মাহাত্ম্য কমেনি কোনোদিনই। 

Powered by Froala Editor