মাটিতে নয়, বেলুনে উড়ে হয়েছিল যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ

সে এক সময় ছিল ইউরোপে। কথায় কথায় শোনা যেত তরোয়ালের ঝনঝনানি। সম্মান বস্তুটি এতই ‘ঠুনকো’ ছিল যে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই শুরু হত দ্বন্দ্বযুদ্ধ। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লড়াইয়ের মধ্যমণি হিসেবে থাকতেন কোনো এক মহিলা। প্রেম মানে তো আসলে প্রভুত্বের অধিকার। যুদ্ধে যে জিতবে, তিনিই পাবেন ‘রাজকন্যা’র সর্বস্ব। আর সেই নারী কী ভাবছেন? জানার প্রশ্নই ওঠে না। পুরুষই ঠিক করে দেবে তার গণ্ডি। তার জন্য লড়াই করে পুরুষ আকাশে উড়িয়ে দেবে বীরত্বের ধ্বজা। এই যখন অবস্থা, তখন নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হত দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য। তরোয়াল বা বন্দুকে ক্লান্ত বীর যোদ্ধাদের দুজন আক্ষরিক অর্থেই আকাশে উড়েছিল ডুয়েল লড়তে।

ঘটনাস্থল ফ্রান্স (France)। সময়টা উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিক। প্যারিসের অপেরার বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী তিরেভিতের (Tirevit) রূপে-গুণে মুগ্ধ গোটা শহর। সময় ও সমাজের বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী একজন সুন্দরী, স্বাবলম্বী যুবতী প্রকাশ্যে নৃত্যপ্রদর্শন করবেন, তা তো হতে পারে না। শহরের অনেক ধনীব্যক্তিই আকৃষ্ট হলেন তাঁর প্রতি। শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই জিতলেন গ্রাঁদপে (Grandpe)। এক কথায়, তিরেভিত হলেন তাঁর রক্ষিতা। কিন্তু, তিনি তো পছন্দ করতেন অন্য একজনকে। তাঁর নাম লে পিক (Le Pique)। এই ভদ্রলোকও উচ্চবংশের, যথেষ্ট ধনী। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বিবাহ করতেন কিনা বলা যায় না, তবে লে পিক-ও পুড়েছিলেন তিরেভিতের রূপের আগুনে।

গ্রাঁদপের চোখের আড়ালেই শুরু হল দুজনের গুপ্ত প্রেম। প্যারিস অপেরা হয়ে উঠল যুগলের কুঞ্জনিকেতন। খবর অবশ্য চাপা রইল না। কিছুদিনের মধ্যেই তিরেভিতের অভিসারের কথা জানতে পেরে জ্বলে উঠলেন গ্রাঁদপে। ব্যর্থ হয়েছে তাঁর প্রণয়। কিন্তু তারচেয়েও বড়ো কথা, লে পিক তাঁর সম্মান নষ্ট করেছে। অতএব, প্রতিশোধ চাই। উপায় একটাই—দ্বন্দ্বযুদ্ধ। তিরেভিতের ‘অধিকার’ নিয়ে প্রকাশ্যে সরব হয়ে উঠলেন শহরের দুই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। কিন্তু, প্রচলিত ডুয়েলের পদ্ধতি নিয়ে কেউই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বড্ড সেকেলে সেই প্রথা। অন্তত একটা বিষয়ে সহমত জানালেন দুজনেই। ফলে আবিষ্কৃত হল এক নতুন পদ্ধতি। ১৭৮৩ সালে, ফ্রান্সেই মনফিয়ের ভাইয়েরা সফলভাবে পরীক্ষা চালিয়েছেন ‘হট এয়ার বেলুন’ নিয়ে। বিশালাকারের এই বেলুনটিতে ধারাবাহিক গ্যাসের জোগান দিয়ে আকাশে ভেসে থাকা যায় অনেকক্ষণ। প্যারিসের দুই ‘প্রেমিক’ ঠিক করলেন, তাঁদের লড়াই হবে এই বেলুনে উড়ে। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে তাঁদের নাম। যে হারবে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু সম্মানের জন্য এটুকু তো করাই যায়। হয় এসপার, নয় ওসপার। 

১৮০৮ সালের ৩ মে তুইরিয়েসের মাঠে গ্যাস বেলুন নিয়ে উপস্থিত দু’জন। অত্যন্ত মনোরম এক সকাল, হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ। উৎসাহী প্যারিসবাসীর মাথার উপরে দেড় কিলোমিটার উচ্চতায় উঠে গেল দুটি বেলুন। উভয়ের মধ্যে দূরত্ব রাখা হল মোটামুটি আড়াইশো ফুট। দুজনের হাতেই ব্লান্ডারবাস বন্দুক। নিয়ম ছিল, প্রত্যেকে গুলি ছুঁড়বে অপরের বেলুনের বিশেষ অংশ লক্ষ্য করে। কাঁটায় কাঁটায় সকাল নটায় শুরু হল যুদ্ধ। প্রথমে গুলি ছুঁড়লেন লে পিক। লক্ষ্যভ্রষ্ট! মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠল গ্রাঁদপের বন্দুক। না, কোনো ভুলচুক হল না। বিপক্ষের বেলুনের পর্দা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে গুলি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবেগে মাটিতে এসে পড়ল লে পিক আর তার বেলুন। সঙ্গে মাটিতে মিশে গেল তাঁর সম্মান, ভালোবাসা আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর জীবন। বিজয়গর্বে আত্মহারা গ্রাঁদপে নিজের আকাশযানটা উড়িয়ে দিলেন আরো খানিকটা উঁচুতে। সপ্তম স্বর্গে দাঁড়িয়ে দেখলেন লে পিকের পরিণতি।

আরও পড়ুন
বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মরণপণ ডুয়েল লড়তে হত স্বামী-স্ত্রীকে! মধ্যযুগের এক বর্বর প্রথা

আর তিরেভিতের কী হল? ইতিহাস নীরব। গল্প তো তৈরি হয় বিজয়ীদের নিয়ে। বড়োজোর স্থান পেতে পারে লে পিকের মতো সাহসী পরাজিতরা। তিরেভিতরা তো শক্তি প্রদর্শনের অজুহাত মাত্র। তাঁদের সম্মান, ভালোবাসা আর অধিকার নিয়ে কেই-বা কবে মাথা ঘামিয়েছে?

আরও পড়ুন
২৪০ বছর আগে, আজকের দিনেই কলকাতায় ডুয়েল লড়েছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুই সাহেব

Powered by Froala Editor