‘মানব না এই দুর্ভিক্ষ’, ক্রোধ আর বেদনা থেকে জন্ম নিল জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’

গত শতকের চারের দশক। পঞ্চাশের মন্বন্তরে বিধ্বস্ত বাংলায় চলছে নতুন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রস্তুতি। শিল্প শুধু আর ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের গল্প বলবে না, হয়ে উঠবে লড়াইয়ের হাতিয়ার। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ছত্রছায়ায় জড়ো হয়েছেন বাংলা তথা ভারতের উদীয়মান প্রতিভারা। বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র থেকে শুরু করে দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—কে নেই সেখানে? ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিস থেকে নবজীবনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার পথে-প্রান্তরে। সেবার বাগবাজারের একটি বাড়ির ছোটোখাটো সভায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র (Jyotirindra Moitra) ‘মধুবংশীর গলি’ আবৃত্তি পাঠ করলেন শম্ভু মিত্র। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ। শম্ভু মিত্রের বাচনভঙ্গির অপূর্ব বিন্যাসের ঊর্ধ্বে উঠে শ্রোতাদের মনে ঘুরতে লাগল কয়েকটি পংক্তি, “ইতিমধ্যে প্রস্তুত থাকো সবাই/ যখন অত্যাচারীর পতন—/ চরম পতন হবে।”

উপস্থিতদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি কবিতাটির গভীরতর অর্থ। সেই আক্ষেপ যেন পূরণ করে দিলেন গৃহস্বামী জগদ্ধাত্রীবাবু। কবিতা শুনতে শুনতে এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন যে শম্ভু মিত্র ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে দুই ভাই বলে ভুল করে বসেন তিনি। আহা! তবু কেউ তো বুঝল। এই সান্ত্বনা নিয়েই ফিরলেন ‘দুই ভাই’। ভালো জিনিসের অর্থ কেউ বোঝে না, শুধু জগদ্ধাত্রীবাবুর মতো লোকেরা ছাড়া। এই দুঃখ নিয়ে সেই রাতে প্রায় সারা কলকাতা চষে ফেললেন শম্ভু মিত্র ও তাঁর আদরের ‘বটুক দা’। পরে অবশ্য প্রবল জনপ্রিয় হয় ‘মধুবংশীর গলি’। সেই দুর্ভিক্ষের দিনগুলির জীবন্ত আলেখ্য রূপ ধরা পড়ে তাঁর কবিতায়। সঙ্গে থাকে এক প্রবল আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ,

“তারপর, বর্গীরা আসে।
আকাশে বাতাসে স্থলে জলে দস্যুদের দুরন্ত পদধ্বনি। ত্রাসে
প্রকম্পিত মৃগীদের মন। অলস দুর্বল স্নেহ কুড়িয়ে নেয় প্রচণ্ড সূর্য।”

সন্তানের মতো এই কবিতাটিকে আগলে রাখতেন ‘বটুক দা’। সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতেন পকেটে নিয়ে। রাতের খাওয়াদাওয়া মিটে গেল শম্ভু মিত্র আসতেন তাঁর বাড়ি। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের অন্ধকার গলি ধরে চিৎকার করে ‘মধুবংশীর গলি’ আবৃত্তি করতেন দুজনে। কখনও সখনও সঙ্গ দিতেন রবীন মজুমদার। 

আরও পড়ুন
শম্ভু মিত্র, গণনাট্য সংঘ, বিতর্ক এবং কয়েকটি সংলাপ

কলকাতার রাস্তায় তখন মৃতদেহের মিছিল। সামান্য ফ্যানের জন্য বুভুক্ষু মানুষের আর্তি কাঁপিয়ে দিচ্ছে একটা সমাজের অস্তিত্বকে। ‘অমৃতস্য পুত্রা’ মানুষ—ডাস্টবিন থেকে খাবার কেড়ে নিচ্ছে কুকুরদের থেকে। মৃত মায়ের শুকনো বুকের উপর পড়ে শেষবারের মতো খাদ্য খুঁজে নিচ্ছে মৃতপ্রায় শিশু। মানব না এই দুর্ভিক্ষ, লৌহমুষ্ঠিতে ফিরিয়ে দিতে হবে প্রত্যাঘাত। যেন ঘোরের মতো চেপে বসে প্রতিবাদের চেতনা। কোনো এক বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। মনে নেই, কার থেকে নিয়েছিলেন কাগজ-কলম। যন্ত্রণা আর ক্রোধ মিশে তৈরি হল ‘নবজীবনের গান’,

আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

“না না না
মানবো না মানবো না।
কোটি মৃত্যুরে কিনে নেবো
প্রাণপণে,
ভয়ের রাজ্যে থাকবো না।”

গণনাট্য সংঘের হয়ে জীবনের মন্ত্র হয়ে উঠল এই গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্র মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠেও ধ্বনিত হল নবজীবনের উচ্চারণ। ‘ভয়েস অফ বেঙ্গল’-এর মাধ্যমে নৃত্য-সহযোগে পরিবেশিত হয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।

৪৬ নং-এর চারতলায় চলত নাচ-গানের রিহার্সাল। দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন ধরা পড়ত নৃত্যের তাণ্ডবে। একবার রিহার্সাল চলাকালীন সশব্দে দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন এক মেমসাহেব। হাতে স্যুপের পাত্র। সেটির দিকে আঙুল দেখিয়ে কাতর কণ্ঠে মেম জানালেন, “দেখো, তোমাদের এই নাচের রিহার্সাল আমার কী দশা করেছে!” কাছে গিয়ে দেখা গেল, স্যুপের প্লেটে ভাসছে তিন তলার সিলিংয়ের প্লাস্টার। নাচের দাপটে ছাদ ফাটিয়ে ফেলেছেন গণনাট্যের শিল্পীরা। আবেগের বশে জ্যোতিরিন্দ্রও যোগ দিতেন সেই দলে। ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল এই তাণ্ডবের কারণ। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝেই হোক কিংবা তাদের কথায় বিশ্বাস করেই হোক, আর উচ্চবাচ্য করেননি তিনি।

তারপর কী হল? দুর্ভিক্ষ শেষ হল, দাঙ্গার পথ ধরে এল দেশভাগ আর স্বাধীনতা। ‘ঝুটা আজাদি’-র বাণীতে নিষিদ্ধ হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। গণনাট্য ভেঙে গেল। শম্ভু মিত্র দল ছাড়লেন, আত্মগোপন করলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-সহ অনেকেই। একদিন মস্কোর রেডিও চ্যানেলে জ্যোতিরিন্দ্র শুনলেন বিনয় রায়ের গলায় তাঁর লেখা গান। পরে জানতে পারেন, মস্কো রেডিও-র ভারতীয় সংগঠকের দায়িত্ব দিয়ে সোভিয়েতে চলে গেছেন বিনয়। দেশের রাজনৈতিক গণ্ডগোল আর নিজেদের মধ্যের অবিশ্বাসের বাতাবরণের ক্লান্তিতে নবজীবনের স্পর্শ নিয়ে এল এই গান। বাংলায় অবহেলিত থাকার কষ্ট কি কিছুটা কমেছিল বিদেশের মাটিতে নিজের গান শুনে?

Powered by Froala Editor