শম্ভু মিত্র, গণনাট্য সংঘ, বিতর্ক এবং কয়েকটি সংলাপ

“জীবনের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা শিবাইয়ে পৌঁছ্যাতে চাই, সেথা শিবাই মেলে না। আর শিবাইয়ের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা জীবনে পৌঁছাতে চাই, দেখি জীবন মেলে না।”

— শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকে নিঃস্ব চাঁদ সদাগরের চাঁপা আর্তনাদ ঝাঁকি দিয়ে যায় বেঁচে থাকার অসহায় প্রশ্নগুলোকে। চারিদিকে মনসার রাজত্ব। শিবের উপাস্যদের বিরুদ্ধে চলছে চক্রান্ত। যাঁরা বাঁচতে চেয়েছিল ব্যক্তির স্বাধীনতায়, গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত না করে গড়তে চেয়েছিল সত্য-সুন্দরকে, তাঁদেরকে পরাজিত একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের শক্তি। 

কিন্তু এই সংলাপ কি শুধুই চাঁদ সদাগরের? নাকি অতলের কণ্ঠস্বরটি ব্যক্তি শম্ভু মিত্রের নীরব উচ্চারণ? ‘শিবাই’-এর সন্ধানে মগ্ন হয়ে তিনি নিজের চারপাশে গড়ে তোলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এক অদ্ভুত বলয়। গণনাট্য সংঘ তো বটেই, নিজের হাতে গড়া ‘বহুরূপী’ থেকেও সরে আসেন। ইচ্ছাপত্রে জানান, কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই যেন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। বিতর্ক আছে, আছে মতবিরোধ। তবু একবার ফিরে দেখা যাক গণনাট্যের সঙ্গে শম্ভু মিত্রের সম্পর্কের দিকগুলি...

১৯৪৩ সাল। বাংলার বুকে ‘পঞ্চাশের মন্তন্বর’-এ মারা গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। শহরের রাস্তায় ‘ফ্যান চাই’-এর অস্ফুট চিৎকার। অথচ বাংলা নাট্যমঞ্চ তখনও নীরব, নিথর। ঘুণ ধরেছে পেশাদার থিয়েটারের আদর্শে, মূল্যবোধে। সেই সময়ে তৈরি হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। উদ্দেশ্য— বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে সমাজবিপ্লবের কথা বলা, মানুষের সমস্যা তুলে ধরা এবং নতুন যুগের সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। নেপথ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। শম্ভু মিত্র তখন পেশাদার থিয়েটারগুলিতে ভেসে বেড়াচ্ছেন। বিজন ভট্টাচার্যরা তাঁকে নিয়ে এলেন গণনাট্যে।

আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

বিজন ভট্টাচার্যেরই ‘নবান্ন’ নাটক দিয়ে হল নতুন যুগের সূত্রপাত। সারা বাংলা জুড়ে তৈরি হল গণসংগ্রামের বাতাবরণ। স্লোগান উঠল ‘জোর প্রতিরোধ’। যুগ্ম-নির্দেশক রূপে শম্ভু মিত্র পেলেন খ্যাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার আদর্শ মঞ্চ ও ভবিষ্যতের থিয়েটার আন্দোলনের পরিকল্পনা। 

আরও পড়ুন
শেষ মুহূর্তে যেন কোনো আয়োজন না হয়; লোকচক্ষুর আড়ালেই বিদায় নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনকে জোয়ারের মত দুকূল ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফ্যাসিস্টরা পরাজিত, এবারের লক্ষ ইংরেজ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমস্যা মিটতেই গণনাট্যে বামপন্থী আদর্শের প্রচারের নির্দেশ আসতে থাকে। প্রশ্ন ওঠে, শিল্পগুণ না রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি? তত্ত্বকথার দ্বন্দ্বে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েন শিল্পীরা। খোদ শম্ভু মিত্র ‘নবান্ন’ নাটকের প্রযোজনা নিয়ে আপত্তি তোলেন। আনকোরা শিল্পী নিয়ে কম দিনের প্রস্তুতিতে নাটক অভিনয় করলে শিল্পমান নষ্ট হবে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে অভিনয় করতে গেলে পাওয়া যাবে না ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। তাই ‘নবান্ন’ বন্ধ। অনেকেই তাঁর মত সমর্থন করেন। স্পষ্ট দুটি ভাগ হয়ে যায় দলের মধ্যে। শুরু হয় অচলাবস্থা।

গণনাট্যের পক্ষ থেকে অবশ্য একটি আলোচনাসভা ডাকা হয়েছিল সমঝোতার জন্য। কিন্তু দু-পক্ষই অনড়। ১৯৪৬-এ সংঘের গোয়াবাগান কমিউনে গুন্ডারা আক্রমণ করে। ফিল্মের কাজে শম্ভু মিত্র তখন মুম্বইতে। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক গতিবিধিকেও মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তিনি। জোর দেওয়া হতে থাকে আনুগত্যে। বিষাক্ত হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পরিবেশ। এই পরিস্থিতিতে শম্ভু মিত্র সংঘ ছেড়ে নিজস্ব নাট্যদল ‘অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়’ তৈরি করেন। যা পরে ‘বহুরূপী’ নামে জনপ্রিয় হয়।

কেন সংঘ ছেড়েছিলেন তিনি? কন্যা শাঁওলী মিত্রের মতে গণনাট্যে ‘মহর্ষি’ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে অপমান করায় তিনি রুষ্ট হন। একই সঙ্গে মনে হতে থাকে, ‘নবান্ন’-এর জন্য প্রাপ্য কৃতিত্ব পাননি। বারবার ‘গোষ্ঠী’ এসে হস্তক্ষেপ করেছে শিল্পীর স্বাধীনতায়। পরবর্তীতেও তিনি পারতপক্ষে গণনাট্যের নাম উচ্চারণ করেননি। বরং ‘সন্মার্গ সপর্যা’ গ্রন্থের ‘নিবারণ পণ্ডিত’ প্রবন্ধে বলছেন,

“গণনাট্য সংঘে ঢুকে নতুন করে তখন আমায় বুঝতে হচ্ছে যে শিল্প কী, আঙ্গিকের সঙ্গে বিষয়বস্তুর সম্পর্ক কী, শিল্পের আবেদনের লক্ষ কী, ইত্যাদি।”

আরেকটি প্রবন্ধে জানান, যাদের শিল্পকলা বোধ নেই, অথচ চিৎকার করে রাজনীতি করে, তাঁরাই হয়ে উঠত গণনাট্যের সর্বেসর্বা। ভাবের আদানপ্রদান হত না, শিল্পের উন্নতি নিয়ে আলোচনা ছিল না। শুধুই রাজনৈতিক আন্দোলন। তাই সরে এসেছেন গণনাট্য থেকে। ‘বহুরূপী’-তে চেয়েছেন ‘রাজনৈতিক দলের ভেঁপুদার’ না হয়ে ‘বুদ্ধিচালিত রুচিসম্মত’ নাট্যপ্রযোজনা করতে। সৎভাবে নাটক করব, ভালো নাটক করব— এই ছিল মন্ত্র। বিপরীতে গণনাট্যের সুধী প্রধানরা তোপ দেগেছেন শম্ভু মিত্রের ব্যক্তিগত উচ্চাশার দিকে। সিনেমায় অভিনয় করব, জনপ্রিয়তা হবে, নিজের নাট্যদলে কর্তৃত্ব থাকবে, এই নাকি ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এই সমস্ত চাপানউতোর থেকে শুরু হয় ‘গণনাট্য বনাম নবনাট্য’ বিতর্ক।

আর ব্যক্তি শম্ভু মিত্র? তিনি একসময়ে নীরব বিদায় নিলেন ‘বহুরূপী’ থেকেও। চাঁদ বণিকের মতই তাঁর নিয়তি। প্রখর ব্যক্তিত্বপূর্ণ আত্মচিন্তায় মগ্ন। যার সামনে অনেক প্রতিভাবানকেও মধ্যদুপুরে প্রবল সূর্যের আলোয় নক্ষত্রদের মতো হারিয়ে যেতে হয়। ফলে বাংলা থিয়েটারের ‘প্রতিষ্ঠান’ হয়েও তিনি একা। একা শেষযাত্রাতেও। জীবনের অঙ্ক মেলে না, শিবের কাছে পৌঁছতে পারেন না। হিসেবে কি ভুল হয়ে গেছিল? উত্তর খোঁজা যাক ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র একটি সংলাপ দিয়েই,

“শিবায়ে স্মরণ কর‍্যা একদিন বীর হতে চেয়্যেছিনু আমি।... ক্রমে ক্রমে একদিন নিজের চায়্যা বড়ো বল্যে হয়তো বা মনে হয়্যেছিল। তাই কয়্যাছিল, নিচ্চয় জয় হবে।... আর তাথেই তো সর্বস্ব দিয়্যাও যেন সর্বস্বটা দেয়্যা হয় নাই তার। তাই চাঁদ ভেঙ্গ্যে গেল, তার পূজা নিল না শিবাই।” 

তথ্যসূত্র—
সন্মার্গ সপর্যা, শম্ভু মিত্র
চাঁদ বণিকের পালা, শম্ভু মিত্র
তর্পণ, শাঁওলী মিত্র
গণ-নব-সৎ নাট্যগোষ্ঠী কথা, সুধী প্রধান

Powered by Froala Editor

More From Author See More