৪০০ বছর ধরে একই নাটক মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে এই গ্রামে!

জার্মানির বাভেরিয়ান আল্পসের উপর অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম। ওবেরামারগাউ। ছবির মতো সাজানো এই গ্রামে পৌঁছালে মনে হবে যেন ডিজনিল্যান্ডে পা রেখেছেন। অবাক করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দোসর সেখানকার লোকশিল্প, কাঠের বাড়ি, স্থানীয় ওয়াইনারি আর দ্রাক্ষাক্ষেত্র। তবে এসবের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, তা হল সেন্ট পিটার ও পল ব্যারোক ক্যাথোলিক গির্জার নাটক। যা জার্মানি (Germany) তো বটেই, সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন প্রযোজনা (Oldest Production)।

হ্যাঁ, একটি নির্দিষ্ট নাটক (Play) এই গ্রামে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। শুধু বদলেছেন শিল্পীরা। প্রাচীন জার্মান ভাষাকে উপস্থাপন করেছে বর্তমান কথ্যভাষা। কিন্তু নাটকের অভিনয় কিংবা মূল সংলাপে সেভাবে বদল আসেনি কোনো। কিন্তু কেন? আদতে ওবেরামারগাউ-এর এই ঐতিহ্যবাহী নাটকের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য এক গল্প। 

আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের কথা। ১৬৩৪ সাল। ইউরোপ জুড়ে তখন থাবা বসিয়েছে ব্ল্যাক প্লেগ। জার্মানির ওবেরামারগাউ-ও রেহাই পায়নি এই মারণ রোগের দাপট থেকে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মুছে গিয়েছিল গ্রামের ২০ শতাংশ জনসংখ্যা। প্লেগ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের অন্যত্র সব জায়গাতেই বাড়ি ছেড়ে সকলে পাড়ি দিয়েছিলেন অন্য অন্য লোকালয়ে। তবে ওবেরামারগাউ-এ সে ঘটনা হয়নি। বরং, রোগ থেকে বাঁচতে ঈশ্বরের সঙ্গে ‘চুক্তিবদ্ধ’ হয়েছিলেন তাঁরা। সেটা কেমন? 

সেন্ট পল ও পিটার গির্জার এক পাদ্রির উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এক ভিন্ন নাটকের প্রযোজনা। নাটকটির প্রেক্ষাপট মূলত যিশু খ্রিস্টের জীবন, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানকে কেন্দ্র করেই। এই ধরনের নাটক সে-সময় ইউরোপের প্রায় সর্বত্রই দেখা যেত। তবে বিশেষত্ব হল, জার্মানির এই ছোট্ট গ্রামে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সমাধিক্ষেত্রে। প্লেগে মৃত ব্যক্তিদের সমাধির ঠিক ওপরেই। শুধু তাই নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে সেখানকার পাদ্রি নাকি চুক্তি করেছিলেন, প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর মঞ্চস্থ হবে এই নাটক। চলবে আজীবন। কিংবদন্তি বলে, এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরেই নাকি ব্ল্যাক প্লেগের ছায়া সরে গিয়েছিল ওবেরামারগাউ-এর আকাশ থেকে। আর একটিও প্রাণ যায়নি গোটা শহরে। 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের নাটক-কথা, নাট্য-কথা

এর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৩৮৮ বছর। ফ্র্যাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ-সহ একাধিক ঘটনার সাক্ষী থেকে জার্মানির এই গ্রাম। বয়ে গেছে স্প্যানিশ ফ্লু, প্লেগ, কোভিড মহামারীর মতো ঘটনাও। কিন্তু তারপরেও থেমে যায়নি এই প্রথা। ১৭৭০ সালে বাভারিয়ার ডিউক দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ন জোসেফ এই নাটক নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তবে লাভ হয়নি তাতে। বরং, গোটা ওবেরামারগাউ-এ সামিল হয়েছিল প্রতিবাদে। 

আরও পড়ুন
জেলবন্দিদের জন্য শেক্সপিয়রের নাটক

১৯০০ সালে জার্মান উদ্যোক্তা থমাস কুক এই নাটকটির বাণিজ্যায়ন করতে তৈরি করেন আস্ত একটি থিয়েটার। ৪৪০০ আসনের সেই থিয়েটারেই প্রতি ১০ বছর অন্তর প্রদর্শিত হয় পাঁচ ঘণ্টার নাটকটি। আয়োজক সেন্ট পল ও পিটার গির্জার যাজকরাই। বর্তমানে শুধু জার্মান ভাষা নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ইংরাজি, ফরাসি ও অন্যান্য ভাষাতেও মঞ্চস্থ হয় যিশুর জীবনকাহিনি। 

আরও পড়ুন
পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন ক্লাসিক্যালের অনুশীলনও – ‘বিসর্জন’ নাটক থেকে বার্তা থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর

২০২১ সালে মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল এই নাটকের আরও একটি সংস্করণ। তবে মহামারীর কারণে গতবছর তা সম্ভব হয়নি। এবার করোনার প্রকোপ কমতেই ফের শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। আর কিছুদিনের মধ্যেই মঞ্চস্থ হবে এই নাটক। তা নিয়েই সাজো সাজো রব জার্মানির ছোট্ট পার্বত্য জনপদটিতে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More