শেষ মুহূর্তে যেন কোনো আয়োজন না হয়; লোকচক্ষুর আড়ালেই বিদায় নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র

সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে ছেলেটি। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাঙ্গণে তখন চলাফেরা। কিন্তু এমন বদ্ধ পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাঁধন ঠিক পছন্দ হল না। ততদিনে কবিতা, সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে সে। এবার নিজেকে একটু চেনার পালা; গাছ যাতে খোলা মনে বাড়তে পারে সেজন্য ছেড়ে দিল কলেজ। বাবার সঙ্গে চলে গেল লখনউ, এলাহাবাদ। স্থানীয় লাইব্রেরির বইয়ের পাতাগুলো হয়ে উঠছে ছেলেটির সঙ্গী। এরকমই একদিন লাইব্রেরির পড়াশোনার শেষে বাড়ি ফিরল সে। শুনল ঠিক পাশের বাড়িতেই ‘আলমগীর’ নাটকের রেকর্ড বাজছে। ছেলেটা একমনে শুনে গেল সেই শব্দ, সেই সুর। ভেতরে কী যেন একটা বেজে চলেছে! ছেলেটা ঠিক করে ফেলল জীবনের গতিপথ। নাটকই করতে হবে তাকে, নাহলে বড়ো মুশকিল। এলাহাবাদের সেই সন্ধ্যা জন্ম দিল বাংলা নাটক ও সংস্কৃতি জগতের এক প্রবাদপ্রতিম নামের। সেদিনের সেই মুহূর্তের কাছে পরে কখনও কি ফিরতে ইচ্ছা করেছিল শম্ভু মিত্রের?…

শম্ভু মিত্র— নামটি উচ্চারণের সঙ্গে ভেসে আসবে একটা চলমান সময়ের ছবি। আজকের গ্রুপ থিয়েটারের সার্থক রূপদাতাদের মধ্যে তিনি তো থাকবেনই; সেই সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের এক বদলের মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব— এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে একটা সময় বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠে ‘বহুরূপী’। এই অধ্যায়ের পরে তো বটেই, আগেও একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল মিথ। ‘নাট্যনিকেতন’ থিয়েটার উঠে যাবার পর সেখানেই যাত্রা শুরু করলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। নতুন নাম ‘শ্রীরঙ্গম’। এই সমুদ্রে এসে তরী ভিড়ল শম্ভু মিত্রের। কিন্তু কোথাও যেন মন পাচ্ছিলেন না তিনি। এই বাড়ি, ওই বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে সময়ও তখন উত্তাল। চল্লিশের দশক বাংলা বা ভারত নয়, গোটা পৃথিবীই এক বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। আর আগুনের ভেতরেই তো জন্ম নেয় বিপ্লব। সেভাবেই জন্ম নিল ‘পিপলস থিয়েটার’, অর্থাৎ গণনাট্য সংঘ। যেখান থেকে বাংলার সংস্কৃতি জগতে এক নতুন হাওয়া আসা শুরু। 

এমন পরিস্থিতিতেই দীক্ষা শম্ভু মিত্রের। ‘উলুখাগড়া’, ‘আগুন’, ‘নবান্ন’, ‘জবানবন্দী’— একের পর এক মিথের জন্ম সেই সময়। যা কেবল নন্দনচর্চা নয়, মানুষেরও কথা বলে। সেই গণনাট্য ছেড়েও একদিন বেরিয়ে আসেন শম্ভু মিত্র। তিনি ততদিনে দিশা পেয়ে গেছেন। যা জন্ম দিল ‘বহুরূপী’র। আর বহুরূপীর হাত ধরে জন্ম নিল আরও কিছু রূপকথা। সালটা ১৯৫৪। শম্ভু মিত্র ঠিক করলেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করবেন তিনি। কোনটা? ‘রক্তকরবী’! সবাই অবাক হয়ে যান এই সিদ্ধান্তে। কারণ, জীবিত অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ চেয়েও এই নাটক মঞ্চস্থ করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, এর ভাষা লোকের কাছে দুরূহ হয়ে যাবে। সেখানে সম্পূর্ণ নাটকটি অক্ষত রেখে মঞ্চস্থ করা, এটা রীতিমতো সাহসের একটি কাজ। কিন্তু এমন একটি নাটক দর্শকের কাছে পৌঁছবে না, এটা যেন পীড়াই দিচ্ছিল শম্ভু মিত্রকে। শেষ পর্যন্ত তাঁরই নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল ‘রক্তকরবী’। বাকিটা, ইতিহাস… 

বাংলা নাট্য জগতে যে ধারাটি শুরু করেছিল বহুরূপী, আজ তারই ফসল আমরা দেখতে পাই। তবে শম্ভু মিত্র কি কেবল নাটকেই আটকে থাকবেন? শুধু মঞ্চে নয়, বেতারেও নিয়ে এলেন নাটককে। আর ছিল আবৃত্তি, যার সঙ্গে সেই ছোট্ট থেকে গাঁটছড়া বাঁধা তাঁর। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে তখন একসঙ্গে পড়তেন শম্ভু মিত্র এবং তাঁর ভাগ্নে দুর্গা। একদিন ক্লাসের মধ্যেই দুর্গা ‘রঘুবীর’ নাটক থেকে আবৃত্তি করে উঠল। সেই আওয়াজ, সেই দৃশ্যের সামনে বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে বসিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর নিজের কথায়, সেই আবৃত্তির সামনে নিজেকে তুচ্ছ মনে হত। ছোটো থেকেই ছিল অসম্ভব স্মরণশক্তি। আর জীবন তরীটির মাঝি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গুরুদেবের রচনার কাছে বারবার ফিরে গেছেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক চার দেওয়ালের গণ্ডি ছেড়ে তিনিও তো মুক্তির স্বপ্নই দেখেছিলেন… 

আরও পড়ুন
হিন্দি সিনেমায় ব্যর্থ হলেন ‘বহিরাগত’ উত্তমকুমার, ষড়যন্ত্রে জড়িত বলিউডের রথী-মহারথীরাও?

স্বপ্ন! সারাটা জীবন জুড়ে এই স্বপ্নই দেখে গেলেন শম্ভু মিত্র। এই সমস্ত মানুষদের আমরা কিংবদন্তি বলে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু একবারও ঝুঁকে দেখি, তাঁদের জীবন আর কী কী বলছে? স্বপ্ন এসেছে, ভেঙে চুরে গড়িয়ে গেছে মাটিতে। তবুও সূর্যের আলোকেই পছন্দ করতেন তিনি। ভাবতেন, একদিন সকাল হবে। স্বপ্ন জোড়া দিয়ে গা ঝেড়ে উঠে পড়তে হবে। বহুরূপী তৈরির সময় শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র অর্থসংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। তার মধ্যেও একটু একটু করে বাড়তে দিচ্ছিলেন গাছগুলোকে। কাজ, কাজ এবং কাজ। ভালো কাজই হবে শেষ পরিচয়, ‘সংসারে টাকা থাকবে না দুগ্গা’… সমসাময়িক সমাজের ছবি, মানুষের অবস্থা সমস্তটাই উঠে আসত সেখানে। কিন্তু এইসব কাজ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন, ঝড় এসেছে, ছেড়ে চলে গেছে কাছের মানুষরা। কিন্তু কখনও খারাপ রাস্তা বাছেননি। কারণ ‘মা আকাশ থেকে সব দেখছেন!’ আর স্বপ্ন দেখাও ছাড়েননি তিনি। ওটা দেখা বন্ধ হয়ে গেলে তো… 

জীবন নাট্যের ড্রপসিনও পড়ল নিরালায়। ১৯৯৭ সালের ১৮ মে। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসল বাংলার নবনাট্যের প্রবাদপুরুষের। কিন্তু কেউ জানতেও পারল না। কোনো সম্মান, গান স্যালুট, স্মারক স্মৃতি— সুযোগই দিলেন না শম্ভু মিত্র। মেয়ে শাঁওলি মিত্রকে বলে গিয়েছিলেন নিজের শেষ কথাগুলো। দিনের শেষে একজন সামান্য মানুষ তিনি। তাই শেষবেলাও যেন সেই সামান্য আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। তাই হয়েছিল। গভীর রাতে, সবার অলক্ষ্যে সিরিটির শ্মশানে জ্বলে উঠলেন তিনি, শেষবারের মতো। শ্মশানের কর্মীটি জিজ্ঞেসও করলেন, ‘ইনি কি সেই শম্ভু মিত্র?’ উত্তর পাননি তিনি। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে মঞ্চে ওঠার প্রস্তুতি। এটাই তো চেয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে তখন তিনি অনেক দূরে…     

আরও পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত

Powered by Froala Editor

More From Author See More