ব্রাউন লেডি, এক ‘সত্যি’ ভূতের ছবি

কথায় আছে দশচক্রে ভগবান ভূত। অর্থাৎ বহু চেষ্টায় সত্যকে মিথ্যা বানানো। ভূত কি সত্যিই আছে? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন আছে, তো কেউ বলেন নেই। কিন্তু যদি বলি, ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন স্বয়ং ‘তিনি’, বিশ্বাস করবেন?

ইংল্যান্ডের রেনহাম হলের ‘ব্রাউন লেডি’ (Brown Lady) এখনও পর্যন্ত তোলা বিখ্যাত এক ভূতের নিখুঁত ছবি। ১৯৩৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে ‘কান্ট্রি লাইফ’ ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফাররা এ ছবি তুলেছিলেন। ইংল্যান্ডের নরফোকে অবস্থিত এই রেনহাম হলের (Raynham Hall) বয়স ৪০০ বছর। বিশ্বের অন্যতম ‘মোস্ট হন্টেড প্লেস’ও এই হল। এর ইতিহাস শুনলে পিলে চমকে উঠতে পারে। শোনা যায়, ‘ব্রাউন লেডি’-র আত্মা এই হলটিতে বিচরণ করে। 

কে এই ব্রাউন লেডি? তাঁর আসল নাম লেডি ডরোথি ওয়ালপোল। সম্পর্কে ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট ওয়ালপোলের বোন। লেডি ডরোথিকে তাঁর বাবা জোর করে বিয়ে দেন চার্লস টাউনশেন্ডের সঙ্গে। ১৭১১ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগের পর ডরোথিকে বিয়ে করেন চার্লস। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ টাউনশেন্ড খামখেয়ালি, বদমেজাজি। তিনি নাকি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী লেডি ডরোথিকে একটি ঘরে বহুদিন তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

বিয়ের আগে লেডি ডরোথির মনের মানুষ লর্ড ওয়ার্টন। যদিও ডরোথির বাবার ঘোরতর অপছন্দের ওয়ার্টন। ফলত ‘আদর’-এর কন্যাকে জোর করে টাউনশেন্ডের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে চার্লস খবর পায়, বিয়ের পরও লেডি ডরোথি পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করেন। শাস্তিস্বরূপ ডরোথিকে একটি ঘরে বন্দি রাখা হয় তালাবন্ধ করে। বহু বছর তালাবন্ধ অবস্থায় থাকার পর ১৭২৬ সালে মারা যায় ডরোথি। অনেকেই আবার এই দাবি নস্যাৎ করে বলেন, ডরোথির মৃত্যুর কারণ দীর্ঘ অসুস্থতা। সেই লেডি ডরোথিরই অতৃপ্ত আত্মা রেনহাম হলে নাকি এখনো ঘুরে বেড়ায়। রেনহাম হলের মায়া এখনো ত্যাগ করতে পারেননি ডরোথি।

আরও পড়ুন
ভূতের মুখে ‘গুডবাই’! ব্রিটেনের ঘটনায় চাঞ্চল্য সোশ্যাল মিডিয়ায়

১৯৩৬ সালে লন্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘কান্ট্রি লাইফ’-এর ফটোগ্রাফাররা রেনহাম হলের ভিতরে ফটোশ্যুট করতে যান। ফটোশ্যুটের সময় এমন একটি ছবি তোলেন, যা নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। ছবিটি দেখলে মনে হবে, খাস ‘ব্রাউন লেডি’-র আত্মা ক্যামেরাবন্দি হয়েছে।

আরও পড়ুন
‘নিজে ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ! লজ্জা করে না?’

ওই দিন ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার ক্যাপ্টেন হুবার্ট সি প্রভান্ডের সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকারী ইন্দ্রে শিরা। তাঁদের দাবি, তাঁরা হলের প্রধান সিঁড়ির একটি ছবি তুলেছিলেন। দ্বিতীয় ছবি তোলার জন্যও তখন ক্যামেরা প্রায় রেডি। শিরা হঠাৎ কুয়াশার মতো কিছু একটা দেখতে পান। ক্রমে তা এক মহিলার রূপ ধারণ করে সিঁড়ি বেয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। শিরার নির্দেশ অনুযায়ী প্রভান্ড লেন্সের ক্যাপ খুলে নেন। শিরা তাড়াতাড়ি ট্রিগার টিপে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ চালু করেন। পরে ছবির নেগেটিভ ধোয়া হলে বিখ্যাত এই ছবির জন্ম। রেনহাম হলে প্রভান্ড এবং শিরার এই ভূতুড়ে অনুভূতির কথা ‘ব্রাউন লেডি’-র ছবি সমেত ২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৬-এ ‘কান্ট্রি লাইফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত। ছবিটি পরবর্তীতে ৪ জানুয়ারি ১৯৩৭-এ ‘লাইফ’ পত্রিকাও ছাপে।

প্রভান্ড এবং শিরার সাক্ষাৎকার নেন প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর হ্যারি প্রাইস। তাঁর মতে, ‘ফটোগ্রাফারদের কথা সত্যি বলেই মনে হয়। আমি অনুপ্রাণিতও। যখন শিরা ওই ছায়ামূর্তিকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখেন, প্রভান্ডের মাথা কালো কাপড়ের তলায়। একটা ফ্ল্যাশগান জ্বলে ওঠার ফল আজ আমাদের সামনে। তাঁদের কথা অবিশ্বাস করার কোনো জায়গা নেই। তর্কের খাতিরে গল্পটা বানানো ধরা হলেও ছবির সেই নেগেটিভ তো আর বানানো নয়।’

যদিও এই আলোকচিত্র নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিছু সমালোচক বলেন, শিরা লেন্সে তেল অথবা ওই জাতীয় কিছু লাগিয়ে একটা আকার দিয়েছেন। অথবা এক্সপোজারের সময় নিজেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে তৈরি করেছেন ভ্রম। ছবিটা নাকি ডবল এক্সপোজারের ফলে কিংবা কোনো কারণে ক্যামেরায় আলো ঢুকে যাওয়ায় তৈরি। প্যারানরমাল তদন্তকারী জো নিকেলও বলেন, ডবল এক্সপোজারের সাহায্যেই ছবিটা উঠেছে। জন ফেয়ারলি এবং সাইমন ওয়েলফেয়ার লিখেছেন, ‘প্রতিটি সিঁড়ির উপরে একটি ফ্যাকাশে রেখা রয়েছে। একটি ছবি অন্য ছবির উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রমাণ ওই রেখাই।’

জাদুকর জন বুথ লিখেছেন, ফটোগ্রাফিতে সহজেই প্রাকৃতিক পদ্ধতি নকল করা যেতে পারে। বুথ জাদুকর রন উইলসনকে বিছানার চাদরে ঢেকে দিয়ে হলিউডের দ্য ম্যাজিক ক্যাসেলের বিশাল সিঁড়ি বেয়ে নামতে বাধ্য করেছিলেন। যা অনেকটাই মিলে যায় রেনহাম হলের ‘ব্রাউন লেডি’-র সঙ্গে। কেউ আবার স্ট্যান্ডার্ড ভার্জিন মেরি মূর্তির সঙ্গে ‘ব্রাউন লেডি’-র ছায়ামূর্তির মিল পেয়েছেন। যে কোনো ক্যাথলিক গির্জায় দেখা মিলবে স্ট্যান্ডার্ড ভার্জিন মেরি মূর্তি। এরসঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও ‘ব্রাউন লেডি’-র ভূতুড়ে ছবিটির মিল পাওয়া যাবে। 

বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ছবিটি যেভাবেই উঠুক না কেন, ইংল্যান্ডের নরফোকের শতাব্দী প্রাচীন প্রাসাদে বাদামি পোশাক পরা এক নারীর ছায়ামূর্তি ‘ভূত’ হয়েও যাবতীয় আলো কেড়ে নিয়েছেন।

Powered by Froala Editor