চার মাসে চারশো ভূমিকম্প সেন্ট হেলেনস পর্বতে, সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিজ্ঞানীরা

সারা পৃথিবী জুড়েই প্রকৃতির তাণ্ডবলীলায় প্রশ্নের মুখে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ। যেন মানুষ আর যন্ত্রের অত্যাচার থেকে নিজের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চাইছে প্রকৃতি। তা সে সাম্প্রতিক সিকিমের বন্যা হোক, কিংবা আমাজন অববাহিকার তীব্র খরা। সর্বত্রই বিরাজ করছে একটা অশনি-সংকেত। একই পরিস্থিতি এবার দেখা গেল আমেরিকাতে। নতুন করে জেগে উঠতে চলেছে মাউন্ট সেন্ট হেলেনস (Mount Saint Helens) আগ্নেয়গিরি। গত পনেরো বছর ঘুমিয়ে থাকার পর আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে পর্বতটি। যা চিন্তার ভাঁজ ফেলছে বিজ্ঞানীদের কপালে।

আমেরিকার জিওলজিকাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাস থেকে চারশোর বেশি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে হেলেনস পর্বত সংলগ্ন অঞ্চলে। যদিও রিখটার স্কেলে এর মাত্রা অত্যন্ত নগণ্য। আপাতত ১ ম্যাগনিচিউডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে অধিকাংশ ঘটনা। এমনকি ভূমির উপরিভাগেও অনুভব করা যায়নি সেগুলি। সে অর্থে হেলেনস আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার লক্ষণও নেই। পাওয়া যায়নি কোনো বিষাক্ত গ্যাসের অস্তিত্ব। ফলে তাঁরা আগ্নেয়গিরিকে ‘গ্রিন’ বলেই আশ্বস্ত করেছে সাধারণ মানুষকে। 

কিন্তু ভয়ের কারণ লুকিয়ে আছে হেলেনস পর্বতের ইতিহাসের মধ্যে। ১৯৮০ সালে প্রথমবারের জন্য জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরিটি। সম্পূর্ণরূপে উড়ে যায় পাহাড়ের একটি অংশ। ওয়াশিংটন-সহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ টন ছাই। পূর্বপ্রস্তুতি সত্ত্বেও মৃত্যু ঘটে ৫৭ জনের। ২০০টি বাড়ি, ৪৭টি ব্রিজ, ২৪ কিলোমিটার রেলপথ ও ২৯৮ কিমি রাস্তা পুরো নষ্ট হয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল ধারাবাহিক ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে যার সর্বোচ্চ মাত্রা ওঠে ৫.১। প্রায় ছ’বছর লেগেছিল জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠতে। কিন্তু তারপরেও অব্যাহত থেকেছে হেলেনসের তাণ্ডব। ২০০৮ সালে ফের অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয় এই পর্বতে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তার আগের চার বছরে ছোটোখাটো ভূমিকম্পে প্রায়ই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ত সাধারণ মানুষের জীবন। সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়েছিল বলেই কোনো প্রাণহানি ঘটেনি ২০০৮-এ। 

কিন্তু ভয় তো থেকেই যায়। পনেরো বছর পরে একই পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত তিন মাসে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩০টি করে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে এই অঞ্চলে। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো নতুন কিছু নয় এই পরিস্থিতি। ১৯৮০-র পর থেকে সপ্তাহে ১১টি করে ভূমিকম্প ঘটে চলেছে হেলেনসে। আর তাই আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে নিশ্চিন্ত করতে চান সাধারণ মানুষকে। তাদের রিপোর্টে ইতিমধ্যে কোনো অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা উল্লেখ করা নেই। কিন্তু অন্যান্য অনেক গবেষকই একমত নন তাদের সঙ্গে। চল্লিশ বছর আগের দুর্ঘটনার সময়েই অনেকে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, পরবর্তী বিস্ফোরণটি হবে আরো শক্তিশালী, আরো বিপজ্জনক। ‘ক্যাসকে ভলক্যানো অবজারভেটরির ভূকম্প-বিশারদ ওয়েস তেলেনও সে-কথাই বলেছেন ‘কলম্বিয়ান নিউজপেপার’-কে। তাঁর মতে, এই ছোটো ছোটো ভূমিকম্পগুলি আসলে পূর্ব প্রস্তুতি। এর অর্থ হেলেনসের গর্ভে ফের লাভা সঞ্চিত হচ্ছে। ওয়েসের ভাষায়, নিজেকে ‘রিচার্জ’ করে নিচ্ছে আগ্নেয়গিরিটি। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও মাটির গভীরে নিশ্চয়ই ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যতটা হালকাভাবে দেখা হচ্ছে বিষয়টি, আদতে তার চেয়েও বিপজ্জনক অবস্থায় সেন্ট হেলেনস।

আরও পড়ুন
তুষারে ঢাকা পর্বতে বসে শিশুর মৃতদেহ, বয়স প্রায় ৫০০ বছর

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কর্তব্য কী? সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যদি জেগে উঠতে চায়, তাতে মানুষের ভূমিকা আর কতটুকু? অথচ ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম ভোগ করতে হবে মানবসমাজকেই। খুব বেশি লোকের বসবাসও নয় এই অঞ্চলে। ফলে অগ্রিম নিরাপত্তাপ্রদান ছাড়া আর কোনো সমাধানই দেখতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সার্ভের রিপোর্টে প্রায় উড়িয়েই দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যৎ অগ্ন্যুৎপাতের কথা। সেক্ষেত্রে আদৌ কি সময়মতো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব? জানে না কেউই। তবে পৃথিবীর সবপ্রান্তেই যে প্রকৃতি নিজের মতো করে জেগে উঠছে, তার বার্তা কিন্তু রয়েছে সেন্ট হেলেনসের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে।

আরও পড়ুন
ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ‘বৃদ্ধি’ হচ্ছে আন্দিজ পর্বতের?

Powered by Froala Editor

Latest News See More