ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ‘বৃদ্ধি’ হচ্ছে আন্দিজ পর্বতের?

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতমালা হিসাবে বিবেচিত হয় দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতকে। হিমালয়ের মতোই আন্দিজই ফোল্ড মাউন্টেন বা ভঙ্গিল পর্বত। ইউরেশিয় পাত এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান পাতের সংঘর্ষে যেমন সৃষ্টি হয়েছিল হিমালয়ের, তেমনই আন্দিজের নেপথ্যে রয়েছে নাজকা ও দক্ষিণ আমেরিকান পাতের সংঘর্ষ। টেকটোনিক পাতের চলাচলের জন্য বর্তমানে উচ্চতা বেড়ে চলেছে হিমালয়ের। ঠিক সেভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আন্দিজ (Andes Mountain)। তবে উচ্চতা নয়, বরং তার বৃদ্ধি হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের নিচে, সকলের অলক্ষে। 

হ্যাঁ, সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল এমনি চাঞ্চল্যকর তথ্য। ‘কমিউনিকেশন আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি। গবেষণায় জড়িত ছিলেন কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এই বিশেষ ঘটনাতিকে গবেষকরা নামকরণ করেছেন ‘লিথোস্ফিয়ারিক ড্রিপিং’ নামে। আগামীদিনে এই একই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে মঙ্গল বা শুক্রের মতো গ্রহের ভূপ্রকৃতিও জানা যাবে বলেই অনুমান গবেষকদের। 

প্রশ্ন থেকে যায় অন্য জায়গায়। হিমালয় আদতে নবীন ভঙ্গিল পর্বত। অর্থাৎ, এই পর্বতমালা যে দুটি পাতের সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে, তারা এখনও সচল। অন্যদিকে আন্দিজ প্রাচীন ভঙ্গিল পর্বত। কিন্তু তার পরেও কীভাবে ভূগর্ভে বেড়ে চলেছে সে?

একাধিক মডেল এবং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্পষ্ট হয় বিষয়টি। আদতে, সরাসরি দুটি টেকটোনিক পাতের চাপে নয়, বরং ভূগর্ভস্থ তাপেই এই পরিবর্তন হচ্ছে আন্দিজের। পৃথিবীকে মূলত তিনটি স্তরে ভাগ করে থাকেন গবেষকরা— কোর, ম্যান্টেল এবং ক্রাস্ট। বিশ্বের ক্রাস্ট বা বহির্মণ্ডলের ওপরেই বসবাস করি আমরা। সেখানেই তৈরি হয় বিভিন্ন পর্বত, টেকটোনিক পাতগুলিও রয়েছে এই ক্রাস্টেই। বলা চলে, এই স্তরটি ভাসমান অবস্থায় রয়েছে ম্যান্টেলের ওপর। যা কিনা গলিত লাভা দিয়ে তৈরি। 

এই উত্তপ্ত গলিত স্তরই ভূগর্ভে আন্দিজের ‘উচ্চতা’ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। উত্তপ্ত লাভা সমুদ্রের সংলগ্নে এসে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে গলছে আন্দিজ পর্বত। তবে কঠিন থেকে তা একেবারে তরল হয়ে যাচ্ছে ভাবলে ভুল হবে খানিকটা। বরং, ম্যান্টেলের নীকটবর্তী অঞ্চলে ঘনত্ব কমছে ভূ-পাতের। চামচ থেকে ঠিক যেভাবে মধু কিংবা গাড় সর্ষের তেল গড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেভাবেই খানিকটা ম্যান্টেলের মধ্যে ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে আন্দিজ। এই অবনমনকেই লিথোস্ফিয়ারিক ড্রপ বা ড্রিপিং হিসাবে বর্ণনা করছেন গবেষকরা। একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকরা নিশ্চিত করছেন এই বিশেষ প্রক্রিয়াটিকে। 

তবে আজ নয়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরেই চলে আসছে এই প্রক্রিয়া। বিশেষত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং-অফ ফায়ারের নিকটবর্তী হওয়ায় আরও বেশি করে এই ঘটনা ঘটছে আন্দিজে। মঙ্গল বা শুক্র গ্রহে টেকটোনিক পাত নেই কোনো। তবে আজও উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে এইসব গ্রহের কেন্দ্রক। ফলে সম্ভাবনা থেকেই যায়, সেখানকার পর্বতের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে একই ঘটনা। কাজেই সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার আগামীদিনে মহাকাশবিজ্ঞানীদেরও বড়ো হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, তা বলার অপেক্ষা থাকে না…

Powered by Froala Editor