মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত কয়েক হাজার বছর পুরনো মুদ্রা, কোন পথে এগোবে ইতিহাস?

প্রাচীন মহেঞ্জোদারো (Mohenjo daro) সভ্যতাকে নিয়ে রহস্য আজও অব্যাহত। ধ্বংসাবশেষের প্রতিটি অংশ যেন নিত্যনতুনভাবে চমকে দিতে প্রস্তুত আধুনিক মানুষকে। ১৯২২ সালে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কার করেন শহরটিকে। প্রায় ৪০ বছর লেগে গেছিল খননকর্মে। পাঁচ হাজার বছর পুরনো সভ্যতার বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন বিস্মিত করেছিল সমগ্র বিশ্বকে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। পরবর্তী সময়েও আবিষ্কৃত হয়েছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী। সম্প্রতি মহেঞ্জোদারোতে খোঁজ মিলল হাজার দুয়েক বছর পুরনো তাম্রমুদ্রার (Copper coin)। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই আবিষ্কার নতুন করে লিখতে সাহায্য করবে মহেঞ্জোদারোর ইতিহাসকে। 

সিন্ধু প্রদেশের এই শহরকে ধরে নেওয়া হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম পরিকল্পিত নগর রূপে। রাস্তাঘাট, বাড়ির কাঠামো, এমনকি নিকাশি ব্যবস্থাও নির্মিত হয়েছিল নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে। যে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ গুহায়, জঙ্গলে আদিম জীবনযাপন করছে, তখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা বাস করত পোড়া মাটির তৈরি বাড়িতে। যার বিশেষ খ্যাতি ছিল শস্যভাণ্ডার ও স্নানাগারের নির্মাণ কৌশলের জন্য। বর্তমানে এই শহরটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লরকানা জেলায় অবস্থিত। সে দেশের একদল গবেষকের সাম্প্রতিক খননকার্যের সূত্রেই পাওয়া গেল এক অমূল্য সম্পদ। 

গত ১৫ নভেম্বর, মহেঞ্জোদারো নগরের পশ্চিম প্রান্তে খননকালে সন্ধান মেলে মাটির পাত্রে রাখা অসংখ্য তাম্রমুদ্রার। খননকার্যের কর্মীরা অবশ্য প্রথমে এর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি, ফলে আবিষ্কার করার পরেও ফের মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয় মাটির পাত্রটিকে। পরে ১৫ ফুট গভীরতা থেকে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় অত্যন্ত সাবধানে তুলে আনা হয় পাত্রটি। যদিও সেটির অধিকাংশই ভেঙেচুরে গেছে। কিন্তু মুদ্রাগুলি এতটাই প্রাচীন যে, আঠার মতো সেগুলি লেগে রয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। ফলে পাত্রটি ভাঙলেও তার আকার রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, মহেঞ্জোদারো থেকে শেষবার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে। আবিষ্কর্তার নাম রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনুমান করা হচ্ছে, তাঁর উদ্ধার করা মুদ্রাগুলির মতো এগুলিও কুষাণ আমলের। কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে পরিষ্কার করে, গবেষণাগারে পরীক্ষা ছাড়া স্পষ্ট মতামত দিতে নারাজ মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক দল। প্রথমে পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মাটির পরীক্ষা হবে। তারপর সেখান থেকে বিশ্লিষ্ট করে দেখা হবে মুদ্রার গায়ে লেখা লিপি। অন্তত এক মাস সময় প্রয়োজন এই কাজে। তারপরই জানা যাবে মুদ্রাগুলির প্রকৃত বয়স। সাধারণের জন্য খুলে দিতে আরেকটু সময় লাগতে পারে। গবেষণার কাজ শেষ হলেই মুদ্রাগুলি তুলে দেওয়া হবে লরকানার মহেঞ্জেদারো মিউজিয়ামে।

আরও পড়ুন
‘ঘোড়া ট্রেন’ এবং স্যার গঙ্গারাম, ইতিহাসের অতলে এক আশ্চর্য যাত্রা

তবে একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে তৈরি হতে পারে মুদ্রাগুলি। সেই সময় কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন প্রথম বসুদেব। একইভাবে, ৯৩ বছর আগে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে ২০০০ মুদ্রা আবিষ্কার করেছিলেন, তার মধ্যে ৩৩৮টি ছিল বসুদেবের সময়ের। যার একদিকে ছিল তাঁর নিজের মূর্তি, অন্যদিকে ষাঁড় নন্দীর সামনে ত্রিশূল হাতে অধিষ্ঠিত শিবের ছবি।

আরও পড়ুন
মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেও, ‘ভারতীয়’ হওয়ায় স্বীকৃতি পেলেন না রাখালদাস!

এবারও আশাবাদী ইতিহাসবিদরা। মোট মুদ্রার সংখ্যা এখনই বলা সম্ভব না হলেও, পাত্রটির ওজন প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলো। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত তাঁরা। সাধারণত মহেঞ্জোদারো সভ্যতাকে খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার বছর নাগাদ সময় থেকে অবলুপ্ত বলে ধরা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক আবিষ্কার উসকে দিচ্ছে এক নতুন সম্ভাবনার কথা। তাহলে কি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পরেও নিত্য যাতায়াত ছিল মানুষের? কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিপতিরা কি কোনো বিশেষ কাজে ব্যবহার করতেন এই অঞ্চলকে? ফলে পুরোপুরি ‘অবলুপ্ত’, বলার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাবছেন সংশ্লিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ইতিমধ্যে, ফের শুরু হয়েছে খননকার্য। এখন দেখার নতুন কোন রহস্য অপেক্ষা করে থাকে ঐতিহাসিক এই নগরে...

Powered by Froala Editor