যেভাবে শুরু হল শিখদের কানাডা অভিবাসনের ইতিহাস

শিখ ধর্মের (Sikhism) সূত্রপাত খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে, গুরু নানকের (Guru Nanak) নির্দেশিত পথ ধরে। বহু সংগ্রামের পথ পার করে বর্তমানে শিখ ধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রায় আড়াই কোটি মানুষ শিখ ধর্মাবলম্বী। ভারতের বাইরে তাদের সবচেয়ে বড়ো বসতি কানাডায় (Canada)। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাত লক্ষেরও বেশি শিখ ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন সে দেশে। যা কানাডার মোট জনসখ্যার ২.১ শতাংশ। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবেই বা শুরু হল তাদের কানাডা যাত্রার সূত্রপাত? কী সেই ইতিহাস?

স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে শিখদের স্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তাদের সুস্বাস্থ্য, শৃঙ্খলা ও অস্ত্রবিদ্যার নিপুণতার জন্য। এশিয়ার পূর্ব-প্রান্তে ব্রিটিশ আধিপত্য শুরুর পর শিখদের পাঠানো হত সেই অঞ্চলগুলিতে। সেভাবেই ১৮৯৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের ৬০তম বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কানাডার ভ্যানকুভারে পৌঁছোন ‘রিশালদার মেজর’ কেশর সিং। কানাডায় প্রথম স্থায়ী বসবাসকারী শিখ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাঁকে। বিশ শতকের শুরু থেকে কানাডায় শিখদের ধারাবাহিক অভিবাসন শুরু হতে থাকে। প্রথম দিকে অবশ্য স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নয়, শুধুমাত্র কাজের জন্যই সেখানে যেতেন তারা। সংখ্যাটাও খুব বেশি ছিল না প্রথম দশকে, মাত্র পাঁচ হাজার।

কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের কাজ খুঁজে নিতে দেরি হয়নি। বিভিন্ন কাঠকল, খনি কিংবা রেলের কাজ দক্ষ হাতে সামলাতে থাকে তারা। শ্বেতাঙ্গদের থেকে বেতন তুলনায় অনেক কম হলেও, ভারতে থাকা পরিবারের জন্য তা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু, ক্রমে ভেদাভেদ বাড়তে থাকে কানাডার অধিবাসীদের সঙ্গে। শিখদের জন্য তারা কাজ পাচ্ছে না, জোরদার হতে থাকে এমন দাবি। শিখ সম্প্রদায়ের পোশাক, দাড়ি, জীবনযাপন, গায়ের রঙ ইত্যাদি হয়ে ওঠে ব্যঙ্গবিদ্রূপের বস্তু। চিন, জাপান-সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে কানাডায় শ্রমিকদের আনাগোনা লেগেই থাকত। তাদের প্রতিও হতে বাড়তে থাকে বৈষম্যমূলক আচরণ। একাধিক দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে। উঠতি অসন্তোষের প্রেক্ষিতে তৎপর হয়ে ওঠে কানাডা সরকার। যদিও ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মতো জায়গায় দক্ষ ও পরিশ্রমী শ্রমিকদের কমতি থাকায় শিখদের বিতাড়িত করা সম্ভব হচ্ছিল না।

১৯০৭ নাগাদ প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার শিখ পাড়ি জমাত কানাডার পথে। তাদের মধ্যে মূলত থাকতেন অবসৃত ব্রিটিশ সেনা ও তাদের পরিবার। এদিকে তীব্র হতে থাকে ‘হোয়াইট কানাডা ফরএভার’-এর স্লোগান। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে হস্তক্ষেপ করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী উইলফ্রিড লাওরিয়ের। আইনত শিখদের আগমন বন্ধ করা সম্ভব ছিল না, তাই খুঁজে নেওয়া হয় আইনের ফাঁক। ওই বছরেই কানাডার সরকার দুটি আইন পাশ করে। যেখানে বলা হয়, যে কোনো অভিবাসীকে কানাডায় প্রবেশ করতে হল অন্তত দুশো ডলার সঙ্গে রাখতে হবে, যেখানে ইউরোপীয়দের জন্য তা ছিল মাত্র ২৫ ডলার। অন্য আইনটিতে বলা হয়, মাতৃভূমি থেকে সরাসরি এসে পৌঁছোতে হবে কানাডায়। মাঝে থামা যাবে না অন্য কোনো দেশে। সেই সময় ভারত থেকে সরাসরি জাহাজে কানাডা যাওয়া ছিল অসম্ভব একটি কাজ। এশিয়ার পূর্ব দিকের দেশগুলিতে জাহাজ থামাতেই হত। এই আইনের ফলে দ্রুত শিখ অভিবাসনের সংখ্যা থাকে কানাডায়। 

আরও পড়ুন
শিখ ধর্মগ্রন্থে চণ্ডী-মাহাত্ম্য

এর ঠিক আগের বছর, অর্থাৎ ১৯০৬ সালে ভ্যানকুভারে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘খালসা দিওয়ান সোসাইটি’। শিখদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেয় তারা। ততদিনে কয়েক হাজার শিখ পরিবার স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছে সে দেশে। ধর্মাচারণের জন্য নির্মিত হয়েছে একাধিক গুরুদ্বার। যার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ১৯১১ সালে তৈরি গুরু শিখ মন্দির। ক্রমে রাজনৈতিক কাজকর্মেও অংশগ্রহণ করে তারা। কানাডার নিয়মের কড়াকড়ির জেরে বহু শিখ আশ্রয় নিতে শুরু করেন আমেরিকার কার্লিফোর্নিয়াতে। ১৯১৩-তে সেখানে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘গদর পার্টি’। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যাদের কাজকর্ম। 

আরও পড়ুন
আগুনে বিধ্বস্ত অস্ট্রেলিয়া, ঘরছাড়াদের খাবার জোগাতে এগিয়ে এলেন শিখ দম্পতি

এর মধ্যে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ হংকং থেকে একটি জাহাজ জাপান ছুঁয়ে পৌঁছোয় ভ্যানকুভারে। যার ৩৭৬ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৩৭ জনই ছিলেন শিখ। কিন্তু মোট যাত্রীসংখ্যার মধ্যে মাত্র ২৪ জনকে কানাডা প্রবেশের অধিকার দেয় সরকার। বাকিরা আটকে যান নিয়মের ফাঁসে। বাবা গুরদিত সিং-এর বহু চেষ্টা সত্ত্বেও মেলেনি অনুমতি। বেশ কয়েকদিন বন্দরে আটকে থাকার পর রওনা দিতে হয় ভারতের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে এসে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক মাস সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কলকাতার বজবজে জাহাজ ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় ইংরেজ পুলিশ। নিজের দেশেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে তারা জোর করে নামার চেষ্টা করে। পুলিশের সঙ্গে বেঁধে যায় সংঘর্ষ। সরকারি মতে, পুলিশের গুলিতে মারা যান ২০ জন যাত্রী। আর সেই জাহাজের নাম ছিল ‘কোমাগাতা মারু’। 

১৯১৮-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরেও শিথিল হয়নি নিয়মকানুন। যদিও ‘খালসা দিওয়ান’-এর মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যায় শিখরা। অবশেষে ১৯৪৭-এ মেলে ভোটাধিকার। আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ থাকার পালা। ক্ষমতা বাড়ে রাজনৈতিকভাবেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিছুটা বাধ্য হয়েই অভিবাসন সংক্রান্ত নিয়ম বদলায় কানাডা সরকার। ইউনাইটেড নেশনের অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে জাতিগত বৈষম্যের প্রেক্ষিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার নীতি থেকে সরে আসতে হয়। তাছাড়া, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজন বাড়তে থাকে দক্ষ কর্মীর। যে কাজে ইতিমধ্যেই খ্যাতি ছিল শিখদের। ফলে পুনরায় দরজা খুলে যায় তাদের জন্য। 

ক্রমে ছয়ের দশক থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। জাতিগত পার্থক্য ও বৈষম্য সত্ত্বেও কানাডায় নিজেদের স্থান পাকাপাকি করে নিতে থাকে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। অবশ্য তারপরেও যে বিভিন্ন সময়ে সমস্যা আসেনি, তা নয়। ‘বিচ্ছিন্নতাকামী’ শক্তিরাও মাথা চাড়া দিয়েছে মাঝেমধ্যে। সেসব নিয়েও শিখরা সফল হয়েছে কানাডার বিভিন্ন অংশে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে। বহু উত্থানপতনের অভিজ্ঞতায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে তারা লিখে চলছে নিজেদের ইতিহাস।

তথ্যঋণ :
Sikhism in Canada, The Canadian Encyclopedia
How the Sikh Migration to Canada Begin, The Indian Express

Powered by Froala Editor