ক্যানসার না বিষপ্রয়োগ? আজও প্রশ্নে ঘেরা পাবলো নেরুদার মৃত্যুরহস্য

সেদিন ছিল ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন পাবলো নেরুদা (Pablo Neruda)। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত, কিন্তু থেমে থাকার উপায় নেই। চিলির (Chile) রাজনৈতিক আকাশে তখন ঘোর দুঃসময়। যা কিছু তিনি ভালোবাসেন, যে আদর্শের জন্য আজীবন লড়েছেন—সেসব কিছুই আজ ভেঙে পড়ছে চোখের সামনে। এখন চুপ করে ঘরে বসার থাকার সময় নয়। অনেক দায়িত্ব তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তব হল না কোনো পরিকল্পনা। সেদিন সন্ধ্যাতেই আচমকা ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। ডাক্তার দায়ী করলেন ঘাতক ক্যানসারকে। কিন্তু সত্যিই কি ‘স্বাভাবিকভাবে’ মারা গেছিলেন তিনি? গত এক দশকে এই নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সারা চিলি জুড়ে। প্রশ্ন উঠেছে অসংখ্য। নেরুদার প্রয়াণের পঞ্চাশ বছর পরেও সমাধান হয়নি সেই রহস্যের।

পাবলো নেরুদার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না আলাদা করে। শুধুমাত্র কবি হিসেবে নয়, খ্যাতি অর্জন করেছিলেন একজন রাজনৈতিক বিপ্লবী রূপেও। বামপন্থায় বিশ্বাস ছিল অক্ষুণ্ণ, ছিলেন চিলির কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় হিটলার আর মুসোলিনির স্নেহপুষ্ট ফ্র্যান্সিসকো ফ্যাঙ্কোর শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। সেই সময়েই লেখেন তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ দুটি ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’ (Residence On Earth) ও ‘স্পেন ইন আওয়ার হার্টস’ (Spain In Our Heart)। একাধিকবার যেতে হয়েছে নির্বাসনে। অবশেষে পাঁচের দশকে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন মাতৃভূমি চিলিতে। ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে ‘কান্টো জেনারেল’ (Canto General) কাব্যগ্রন্থসহ অসংখ্য সনেট এবং ওড জাতীয় কবিতা। সেগুলির ভাষা স্প্যানিশ হলেও, অনুবাদের জোরে সারা বিশ্বেই তিনি সমান জনপ্রিয়। কবির যে কোনো দেশ হয় না, তা ফের প্রমাণ করেছিলেন নেরুদা।

১৯৭১ সালে পান নোবেল পুরস্কার। ইতিমধ্যে আরো ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে। চিলির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের অন্যতম পরামর্শদাতা তিনি। নোবেলপ্রাপ্তির পর রাজকীয় সম্বর্ধনারও আয়োজন করা হয় তাঁর জন্য। কিন্তু মাত্র দু’বছরের মধ্যে বদলে যায় সমস্ত পরিস্থিতি। ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর আগুস্ত পিনোশের নেতৃত্বে শুরু হয় সেনা অভ্যুত্থান। আত্মহত্যা করেন আলেন্দে। বিপদের ছায়া গাঢ় হতে থাকে নেরুদার মাথার উপরেও। প্রস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে চলছে মরণপণ লড়াই, কিন্তু প্রিয় দেশকে বিশৃঙ্খলতার মধ্যে দেখতে পারছেন না তিনি। যত দ্রুত হোক চলে যেতে হবে দেশের বাইরে। সেখান থেকে লড়াই চালাবেন সেনা অভ্যুত্থানের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। অভ্যুত্থানের মাত্র বারো দিনের মাথায় চিলির হাসপাতাল থেকে ইঞ্জেকশন নিয়ে ফিরে আসেন বাড়ি। পরদিনই স্বদেশ ছাড়বেন তিনি। কিন্তু সাড়ে ছ ঘণ্টার মধ্যে সাড়া দিতে হল মৃত্যুর ডাকে। 

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৯। ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন বলেই তখন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। সন্দেহ দানা বাঁধেনি কারোর মনে। কিন্তু ২০১১ সালে এক বিস্ফোরক দাবি করেন তাঁর সেই সময়ের গাড়িচালক ম্যানুয়েল আরায়া (Manueal Araya)। ক্যানসারে নয়, নেরুদার মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ায়! হাসপাতাল থেকে ইঞ্জেকশনের সাহায্যে তাঁর ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বিষ। কারণটা তো সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালেই স্পষ্ট। তড়িঘড়ি কোর্টের আদেশে নেরুদার দেহের অবশিষ্ট অংশ তুলে এনে পাঠানো হয় ফরেনসিক পরীক্ষায়। ২০১৫-তেই বিশেষজ্ঞ দল জানান, তাঁর মৃত্যু যে ক্যানসারে হয়নি এ বিষয়ে তাঁরা একশো শতাংশ নিশ্চিত। চিলির সরকারও জানায় যে, এই পুরো পরিকল্পনায় তৃতীয় পক্ষের হাত রয়েছে। কিন্তু পরিষ্কার করে বলা হয়নি যে, কীভাবে তিনি মারা গেলেন। ফলে জারি থাকে তদন্ত প্রক্রিয়া। 

আরও পড়ুন
‘ভূত’ হয়ে নিজেরই খুনের তদন্ত! আজও রহস্যে মোড়া এই কাহিনি

২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণ রিপোর্টটি প্রকাশিত হতেই নির্মূল হয় অনেক সন্দেহ। তাঁর দাঁতে পাওয়া গেছে ব্যাকটেরিয়াম ক্লস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম নামের এক বিষাক্ত পদার্থ। যার প্রয়োগে মৃত্যু অনিবার্য। বহু দেশে জৈব অস্ত্র হিসেবেও চলে এর প্রয়োগ। কিন্তু প্রকৃত অপরাধী কে? আদৌ কি ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘খুন’ করা হয়েছে নেরুদাকে? এমনকী, এই বিষাক্ত পদার্থ যে সেদিনই প্রয়োগ করা হয়েছিল, সে বিষয়েও নিশ্চিত নন গবেষকরা। নেরুদার ভাইপো রোদোলফো রিয়েস অবশ্য হাল ছাড়ার পক্ষপাতী নন। সম্প্রতি বিবিসি-কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, আদালতের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন তাঁরা। যদিও আরেক ভাইপো বার্নার্দো রিয়েস সমস্ত তদন্তকেই ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। 

আরও পড়ুন
চাঁদে মানুষের পা, নাকি স্টুডিয়োয় শুটিং? কুবরিকের দাবি ও অন্যান্য রহস্য

প্রশ্ন উঠছে ম্যানুয়েল আরায়া-র বক্তব্য ঘিরেও। নেরুদার মৃত্যুর পর প্রায় চল্লিশ বছর কেন অপেক্ষা করলেন মুখ খুলতে? তাঁর যুক্তি ছিল, ১৯৯০ পর্যন্ত পিনোশের রাজত্বকালে এই নিয়ে কথা বলা সম্ভব ছিল না। তারপরেও তিনি জানতেন না যে, শুধুমাত্র একটা সন্দেহ নিয়ে কার কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু, তিনিও এখন সমস্ত প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। গত জুনে বয়সজনিত কারণে মারা যান তিনি। ফলে আজও অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে নেরুদার মৃত্যুরহস্য নিয়ে। উত্তরের অপেক্ষায় দেশবাসী, সারা বিশ্বের মানুষও।

তথ্যঋণ : Pablo Neruda : Chilean Poet's death still shrouded in mystery, bbc.com

Powered by Froala Editor