‘ভূত’ হয়ে নিজেরই খুনের তদন্ত! আজও রহস্যে মোড়া এই কাহিনি

জটায়ু থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘হাইলি সাসপিশাস!’ সঙ্গে যে আর কী কী বিশেষণ জুড়ে দিতেন তার ঠিক নেই। ফেলুদা কি শেষ পর্যন্ত সাহায্য নিতেন ‘প্ল্যানচেট’-এর? এই খুনের ঘটনার সঙ্গে যেভাবে ‘ভূত’ জড়িয়ে আছে, তাতে কিছুই আশ্চর্য হওয়ার নয়। না, শেষ পর্যন্ত কোনো গোয়েন্দাকেই ডাকতে হয়নি। খুনের কিনারা করেছিলেন মৃত ব্যক্তি নিজেই! তাঁর ‘আত্মা’ নাকি চিনিয়ে দিয়েছিল খুনিকে।

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এরকম ঘটনাই লুকিয়ে আছে আমেরিকার অপরাধজগতের ইতিহাসে। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। শিকাগো শহরের একটি ফ্ল্যাট থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে প্রতিবেশীরা খবর দেয় দমকলকে। আসে পুলিশও। কিন্তু ঘটনাস্থলে ঢুকে চমকে ওঠেন প্রত্যেকেই। মেঝেতে অর্ধদগ্ধ কার্পেটে মোড়া এক নারীর মৃতদেহ। পিঠে ছুরির একাধিক ক্ষতচিহ্ন। শিকাগোর তীব্র শীতল বাতাসে মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কটূ গন্ধ।

মৃতব্যক্তির নাম তেরেসিটা বাসা (Teresita Basa)। কাজ করতেন স্থানীয় এডগেওয়াটার হাসপাতালে। খুব একটা মিশুকে না হলেও পরিশ্রমী বলে খ্যাতি ছিল তাঁর। রোগীদের সামনে ছিলেন সদা হাস্যমুখ। জন্ম ফিলিপিন্সের অর্থবান পরিবারে। যদিও সংগীতের টানে চলে আসেন আমেরিকা। হাসপাতালে কাজের পাশাপাশি লোলোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। একাই থাকতেন। অসময়ের সঙ্গী বলতে ছিল পিয়ানো। যে কোনো গণ্ডগোল থেকে শতহস্ত দূরে থাকা একজন মানুষ।

এরকম নির্বিবাদী মহিলাকে কে খুন করেছে? আর কেনই বা করেছে? ধন্ধে পড়ে যায় পুলিশ। বাসা-র অতীত ঘেঁটেও কোনো গোপন শত্রুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুধু পাওয়া গেছে কয়েকটি ‘ক্লু’! বাসার ডায়েরি থেকে পাওয়া যায় একটি নামের আদ্যক্ষর—এ. এস। ব্যাস এইটুকুই। তদন্তে আরও জানা যায়, ওইদিন সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাসা কথা বলেছিলেন সহকর্মী রুথ লোবের সঙ্গে। কথায় কথায় জানান যে, জনৈক পুরুষের আসার কথা আজ। কিন্তু কে সেই পুরুষ, কী কারণে তার আগমন কিছুই বলেননি।

আরও পড়ুন
ভূত তাড়াতে ‘অগ্নিবাণ’, ‘শরীর বন্ধন’ কিংবা ‘রক্ষাবাণ’ – বিচিত্র সব মন্ত্রের গল্প

সেই পুরুষই কি এ. এস (A.S)? সেই কি নৃশংসভাবে খুন করেছে বাসাকে? উত্তর মেলে না। পাওয়া যায় না সেই অজ্ঞাত পুরুষের পুরো নাম। ধরেই নেওয়া হয়, এই খুনের কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। ঠান্ডা ঘরে চলে যায় বাসা হত্যাকাণ্ডের ফাইল।

আরও পড়ুন
‘নিজে ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ! লজ্জা করে না?’

কিন্তু ছ-মাস পরের ঘটনায় নড়চড়ে বসতে বাধ্য হয় পুলিশ। গোটা শহরে চাউর হয়ে যায় এক অলৌকিক বর্ণনা। ভিত নড়ে যায় অবিশ্বাসীদের। স্বয়ং বাসা নাকি ‘যোগাযোগ’ করতে চায় পুলিশের সঙ্গে। না, সরাসরি নয়। বাসা-র আত্মা ভর করেছে এক সহকর্মী রেমি চুয়া-র উপরে। তার মুখ থেকেই জানা যাবে, খুনের বিবরণ। হদিশ পাওয়া যাবে আসল খুনির। প্রথমে ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত অতিলৌকিকের সাহায্য নেন ইনস্পেক্টর জোসেফ স্ট্যাচুলা ও তাঁর সহকর্মী লি. আর. এপ্লেন। 

দ্বিধায় ছিলেন রেমি-র স্বামী হোসে চুয়াও। ওই হাসপাতালেরই ডাক্তার তিনি। হঠাৎই একদিন খেয়াল করেন, রেমি এক অদ্ভুত ভাষায় কীসব বলে চলেছে। ভাষাটির নাম ট্যগালগ, যা কিনা বাসা-র দেশের ভাষা। ক্রমে বুঝতে পারেন, তাঁর স্ত্রী-র সাহায্যে কথা বলছে বাসা-র আত্মা। তিনি সাহায্য চাইছেন। প্রাথমিক ঘোর কাটতেই সটান চলে আসেন পুলিশের কাছে।

রেমি-র মুখ থেকে পাওয়া যায় খুনির পরিচয়। উত্তর মেলে এ. এস-এর ধাঁধারও। যার পুরো নাম অ্যালান সোয়ারি (Alan Showery)। আগে হাসপাতালেই কাজ করত। পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে। পুরো ঘটনাটা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ‘সত্যি’টা স্বীকার করতে বাধ্য হয় অ্যালান। সেদিন সন্ধেতে টিভি সারানোর অজুহাতে সে গেছিল বাসা-র অ্যাপার্টমেন্টে। যদিও আসল উদ্দেশ্য ছিল ডাকাতি। বাসা-কে ছুরি দিয়ে খুন করে কার্পেটে আগুন লাগিয়ে গয়না নিয়ে চম্পট দেয় সে। অ্যালানের প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া যায় গয়নাগুলি।

স্ট্যাচুলা তো বটেই, হতভম্ব হয়ে গেছিল প্রশাসনও। অনেকেই অবিশ্বাস করতে থাকে রেমি-র বয়ান। মনে করা হয়, তিনি নিজেই ফাঁসিয়েছেন অ্যালানকে। কিন্তু গয়নাগুলি তো মিথ্যা বলছে না। ১৯৭৯-এ চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হয় অ্যালানের। কিন্তু ১৯৮৩-তেই প্যারোলে ছাড়া পায় সে। 

সত্যিটা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে আজও। তুলনায় উত্তর পাওয়া গেছে কম। প্রশ্ন ওঠে ‘ভূত’-এর কথা মান্যতা দিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও। ততদিনে খুনির ঠিকানা হয়েছে জেলখানায়। ‘ন্যায়বিচার’ পেয়ে কবরের মধ্যে বাসা-র ‘আত্মা’ কি শান্তিতে ঘুমোতে পারলেন? কিছুদিন চলে জোর তরজা। কিন্তু সমাধান মেলেনি। রহস্যের ঘন কালো পর্দায় ঢেকে আছে পুরো বিষয়টি।

তথ্যসূত্র :
The strange case of Teresita Basa : Did her 'ghost' solve her own murder?, mysteriesunsolved.com, 22 Aug, 2023

Powered by Froala Editor