‘রিকশা টানাচ্ছেন ভূতকে দিয়ে! আপনি নিজে পারবেন?’

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৫

আগের পর্বে

মানবেন্দ্র পাল। ১৪০৭ বঙ্গাব্দের শুকতারার সংখ্যায় লিখলেন ‘রহস্যময়ী রোগী’ নভেলা। যার প্রেক্ষাপট একটি ৩৬০ বছরের পুরনো অভিশাপ। বাড়ির পালিতা কন্যা অম্বুজার অদ্ভুত চরিত্র। তার গলা কর্কশ, চোখের মণি কটা আর অবশেসন দাঁড় কাক পোষা। রোগীর শেষ পরিণতি দেখতে পিছু নেন তার ডাক্তার। আর শ্মশানের কাছে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ডাইনির। এক বিকট অভিজ্ঞতা। মানবেন্দ্র পালের লেখায় নেই কৌতুক। তা পড়লে শিরশির করবে গা,  অস্বস্তি হবে। আবার ‘ম্যাকবেথের তরোয়াল’-এর মতো গল্পে তিনি সমকালে তুলে এনেছেন পুরাকাহিনির চরিত্রদের। ভৌতিক কাহিনীর ইতিহাস এই লেখকের সংকলন ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ।

সেই ছোটবেলায় মা শিখিয়ে দিয়েছিল, রাত্তিরবেলা চেনা কেউ ডাকলেই সাড়া দিতে নেই। একবার ডাকলে অপেক্ষা করতে হয়। দ্বিতীয়বার... তৃতীয়বার ডাকুক,  তখন সাড়া দিলে ভয় নেই। ‘নিশি’ হইতে সাবধান। ওরা এরকমই আসে, চেনা কারও গলা নকল ক’রে ডাক দেয়। সেই ডাকে সঙ্গে সঙ্গে যে সাড়া দিয়েছে সে গেল এবং চিরতরেই। ...এ–দেশে কলিংবেল-এর ব্যাপক চলন হতে ‘নিশি’র সুদিন ঘুচেছে।

গত শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার গ্রাম কি মফসসলের এমনই কিছু ‘নিজত্ব’ ছিল। বিদেহী প্রেতকে চেনানো হত বিবিধ ক্যাটেগরি দিয়ে...  জনপ্রিয় ছিল ভুলো, আউল্যা, বেঁশো ভূত, জুজু, নিশি ইত্যাদি নাম। এদের মধ্যে ‘আউল্যা’ ও ‘নিশি’-র রকম অনেকটা একই বলা যায়। আউল্যা হচ্ছে গ্রামের সেই ভূত যে প্রিয়জন সেজে মাঝিকে ভুলিয়ে নদীতে নিয়ে যায় এবং জলে ডুবিয়ে মারে।   

ভুলো – নির্জন পথিককে পথ ভুল করিয়ে দেয়, ঘুরিয়ে নাকাল এবং শেষে হত্যা করে। বেঁশো ভূত? সে পথের মধ্যে ফেলে রাখে বাঁশ এবং  সেইটি টপকালেই তাকে তুলে নিয়ে মটকানো হয় ঘাড়। 

এরকমই... ‘নিশি’ও একটি ক্রূর, অজানিত, ষড়যন্ত্রময় সত্তা হিসেবে এ দেশে যথেষ্ট দুর্নাম কুড়িয়েছিল। 

অখিল নিয়োগী 

 

অখিল নিয়োগী (১৯০২-১৯৯৩), যিনি ছোটোদের মহলে ‘স্বপনবুড়ো’ ছদ্মনামে খ্যাত, আলোচ্য কিংবদন্তী নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, গল্পের নাম-  ‘নিশির ডাক’। গ্রাম-বালক ঝন্টা আর  আহ্লাদীপিসি মুখ্য চরিত্র। ভাইপোর প্রতি পিসির টান ছিল অবসেশনের পর্যায়ে। মৃত্যুর পরেও তা বজায় থাকে এবং প্যারানয়েড, বিকৃত পর্যায়ে চলে যায় অশরীরী স্নেহ। এক নিঝুম রাতে ‘নিশি’ ডাক দেয় ঝন্টাকে এবং তৎক্ষ  ণাৎ সাড়া দিতে ক্রুর উদ্দেশ্যটি হাশিল হয়ে যায়। এপার এবং ওপারের গাঁটছড়ার নমুনাগুলি প্রকাশ পায় নানা অলৌকিক কাণ্ড হয়ে যা আতঙ্কে জমিয়ে দেবে বাড়ির লোককে। 

দেখা যায় পিসি-ভাইপোর সম্পর্ক প্রায় সামাজিক ট্যাবুর জায়গায় চলে গেছিল, ঝন্টার প্রতি আহ্লাদীর কমপ্লেক্স আদতে ইনসেসচুয়াস এবং অবদমিত বললে ভুল হয় না। তারপর বহু দিন কেটে গেছে, জানাচ্ছেন কথক। ...মাঝরাতে, জলার ধারে আজও এক এলোচুল, উন্মাদিনী অপচ্ছায়া কাঁদে, বুক চাপড়ে ছোটাছুটি করে – যে জলাতে শেষবারের মতো সে ঝণ্টাকে ভুলিয়ে টেনে নিয়ে যায়। 

ভয় নয়, একরকম শিরশিরে মায়াতে আমরা আচ্ছন্ন হই।

লীলা মজুমদার

 

লীলা মজুমদার (১৯০৮-২০০৭) বেশ কিছু ভূতের গল্প যেমন লিখেছেন সম্পাদনা করেছেন তারও বেশি ভৌতিক-সংকলন। ‘চেতলার কাছে’, ‘বাতিঘর’, ‘ন্যাপা’, ‘পেনেটিতে’ গল্পগুলি এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। শেষ গল্পটি উৎকৃষ্টতর এবং প’ড়ে সত্যিই ভয় লাগে। 

যাকে আজ পানিহাটি নামে সবাই চেনে, সেই ‘পেনেটি’-র গঙ্গার ধারে পুরোনো বাগান-বাড়ি। বেড়াতে এসে প্রটাগনিস্ট কিশোরের ভাব জমে যায় তিন জেলে ব্যাক্তির সঙ্গে, নাম তাদের শিবু, সিজি আর গুজি। নির্জন নদীতীরে তিনজন দিনের পর দিন সঙ্গ দেয় ছেলেটিকে। বন্ধুদের ভূতের ভয় দেখাতে চাইলে সাগ্রহে রাজিও হয়ে যায়।  ...লাভের মধ্যে বন্ধুরা যায় মূর্ছা, শাদা কাপড়ে ঢাকা তিনমূর্তি কর্পূরের মতো যখন মিলিয়ে গেছে আর কাপড়গুলি জমিতে ঝরে পড়েছে যেহেতু তাদের ভিতরে কেউ নেই। 

‘ও শিবু! ও সিজি! ও গুজি!’ শত ডাকলেও সাড়া আর মেলে না। শিবুরা চিরতরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু... কে বিশ্বাস করবে তার কথা?

চমৎকার প্রিসিশন, স্মরণীয় একটি গল্প। 

বিমল কর

 

লিখতেন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা আর ভূতের গল্প, বাল্য থেকেই  বিমল কর (১৯২১-২০০৩) ছিলেন তাঁর ভক্ত। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের সেই নামজাদা লিখিয়ে সারদাচরণ যখন বৃদ্ধ, আলাপ হয় এবং অল্প দিনেই বন্ধুত্ব জমে ওঠে। ‘আপনি ভূতের গল্প লেখা হঠাৎ ছেড়ে দিলেন কেন?’ লেখক শুধোতে সারদাচরণ হাসলেন এবং শোনালেন একটি আশ্চর্য গল্প – পড়ে হাসবেন না আঁতকে উঠবেন সে মর্জি সম্পূর্ণ পাঠকের।  

সারদাচরণ যখন যুবক, রাতের শহরে আলাপ হয় এক ব্যাক্তির সঙ্গে। সে প্রথমটায় তুম্বো মুখ করে ছিল, তারপর যেচেই একগাদা নালিশ করে যায় তাঁর কাছে। ফরিয়াদী সে, আসামী এখনকার লেখকরা। একই পাপে দুষ্ট সারদাচরণ-ও।

সত্যিই কি আক্কেল নেই তাঁদের?  একসময় হানাবাড়ি, জঙ্গল, জলার ধার এই সবের বাইরে ভূতেরা বিশেষ বেরোত না আর সেইটা তাদের সম্মানের পক্ষে হানিকর কিছু ছিল না। - আর এখন? ড্রয়িংরুমে এনে বসানো হচ্ছে, অমলেট খাওয়ানো হচ্ছে, গল্প গুজব চলছে... শেষে গিয়ে ফাঁস হচ্ছে জ্যান্ত, টাটকা অতিথি একজন নিরালম্ব, বাসি প্রেত! এমনকি ভূতকে দিয়ে রিকশা অবধি টানানো! ...‘আপনি নিজে পারবেন অতখানি টানতে?’ 

সারদাচরণ স্তম্ভিত। এ-হেন ভূত বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তি ওপারের সমস্ত খবরই রাখেন দেখা যাচ্ছে! ‘কিন্তু আপনি কে?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে একটি বোমা ফাটে। ...নাক ও কান

দুটিই মুলে চিরতরে ভৌতিক গল্প লেখা বন্ধ করেন রোমাঞ্চ সিরিজের লেখক, অতঃপর। 

রোমাঞ্চ ও অশরীরী সাহিত্য নিয়ে এক অপূর্ব প্যারোডি। বাঙালি লেখকদের অতি ব্যবহৃত সহজ কৌশলগুলির তুলোধোনা হয়েছে, দস্তুর মতো চিমটি কাটা হয়েছে এবং তৎসহ গল্পটি নিজেও ভৌতিক। বিমল করের ‘সেন্স অব হিউমর’ এখানে সেই বৈঠকী আমেজ আনে – আরো অনেক কিছুর মতোই আমাদের জাতির যেটি খোয়া গিয়েছে এবং ‘আর ফিরিবে না’ বলে সংবাদ। 

Powered by Froala Editor