মাল্টিপ্লেক্স নয়, গ্রামের মাঠেই প্রিমিয়ার; নতুন ইতিহাসের জন্ম দিচ্ছে ‘দুধপিঠের গাছ’

সিনেমাহল বা মাল্টিপ্লেক্সের ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ বা কৃত্রিম ঠান্ডা হাওয়া এখানে নেই। বদলে আছে বিশাল একটি মাঠ। গ্রামের ধারে সেই মাঠেই আগামী ২০ তারিখ জড়ো হবেন একদল মানুষ। সামনে টাঙানো সাদা পর্দার দিকে চোখ থাকবে সকলের। আর সেখানেই শুরু হবে ‘দুধ পিঠের গাছ’। উজ্জ্বল বসু পরিচালিত সিনেমাটির কথা ইতিমধ্যে গোটা বাংলা জেনে গেছে। জেনে গেছে আড়ংঘাটা গ্রামের কথাও। এবার সেই গ্রামের বুকেই, আড়ংঘাটা ফুটবল খেলার মাঠে আয়োজিত হবে সিনেমাটির প্রিমিয়ার-সন্ধে। শহুরে মাল্টিপ্লেক্সের বদলে এই প্রথম গ্রামের খোলা মাঠে কোনো সিনেমার প্রিমিয়ার আয়োজিত হচ্ছে। বাংলা সিনেমার জগতে এর আগে এমন উদ্যোগ হয়েছে কি?  

গ্রামেরই এক ছোট্ট ছেলের স্বপ্ন দিয়ে সিনেমাটির যাত্রা শুরু। ছবির পরিচালক উজ্জ্বল বসু এই গ্রামেরই বাসিন্দা; একটা সময় এখানে শিক্ষকতাও করেছিলেন। সেখানেই দেখা হয় ছেলেটির সঙ্গে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলা। অন্যরকম ছবি, গ্রামের সহজ মানুষদের সহজ যাত্রার গল্প। কিন্তু কীভাবে তৈরি হবে ছবিটি? এমন ছবির প্রযোজক কোথায়? এখান থেকেই শুরু হল ‘দুধ পিঠের গাছ’-এর লম্বা পথ চলা। আড়ংঘাটা গ্রামের মানুষগুলোর অর্থসাহায্যেই তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। ঠিক যেভাবে একটা গাছ বাড়ে, সেভাবেই বেড়ে উঠেছে সিনেমাটি। ভেতরে-বাইরে, সমস্ত জায়গায় হয়ে উঠেছে প্রকৃত ‘দুধ পিঠের গাছ’… 

আর তাই যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল গ্রামেই সিনেমাটির প্রিমিয়ার আয়োজিত হবে, তখন উত্তেজনায় ফেটে পড়ল সবাই। আড়ংঘাটার বাসিন্দা এবং এই ছবির অন্যতম অভিনেতা ও প্রযোজক চন্দন মোদক প্রহরকে জানালেন, “উত্তেজনা তো আছেই। সিনেমাহলে গিয়ে দেখার আলাদা উৎসাহ থাকলেও, প্রিমিয়ারের আনন্দে কোনরকম ভাটা পড়ছে না। তবে এখন যেহেতু করোনার সময়, তাই একটু সাবধানেই থাকতে হচ্ছে সবাইকে। আমরাও সেইমতো ব্যবস্থা নিচ্ছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সাবধানতা নিয়েই সবাই ২০ তারিখের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এখানে।”

এই করোনা পরিস্থিতির জন্যই ৩ এপ্রিল সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। ছবির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলী, পরিচালক ভেঙে পড়েছিলেন; গ্রামের মানুষগুলোও মুষড়ে পড়েছিলেন। তারপরেই পরিস্থিতি বদলে গেল। ‘দুধ পিঠের গাছ’-এর সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি জানালেন, “আমরা তো বটেই, ওঁরাও বেশ ভেঙে পড়েছিলেন করোনার জন্য। এত কষ্ট করে বানানো ছবিটা পিছিয়ে গিয়েছিল। তারপর ওই মানুষগুলোই আমাদের সাহস যোগালেন। তাঁদের মুখে একটাই কথা তখন, ‘চিন্তা করো না, আমরা আছি’। এটাই অনেকটা সাহস জুগিয়েছিল। এবং সত্যিই, প্রতিটা মুহূর্তে পাশে থেকেছে আড়ংঘাটা। এমনকি, এখনও আমরা প্রিমিয়ার বা ছবিমুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। কত মানুষ আসবেন, সেই নিয়ে সন্দেহ ছিল। শেষে গ্রামের মানুষরাই এগিয়ে এসেছিল। তাঁরা সঙ্গে আছেন বলেই এত সিদ্ধান্ত নিতে পারছি আমরা।”

আরও পড়ুন
সিনেমার প্রযোজক প্রত্যেকেই; অর্থনৈতিক সংকটেও আশা হারাননি আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা

এইভাবেই একটা সিনেমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জুড়ে গেল একটি গ্রাম। সেই মানুষগুলো প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থেকেছেন তাঁদের প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’য়ের। সেই ভালোবাসার টানেই বারবার ফিরে আসেন উজ্জ্বল বসু। শহরের বাইরে গিয়ে, আড়ংঘাটা ফুটবল খেলার মাঠে এমন একটি প্রিমিয়ারের আয়োজন— ভাবাই যায় না। কথাপ্রসঙ্গে ছবিটির পরিচালক উজ্জ্বল বসু প্রহরকে জানাচ্ছিলেন, “মানুষ প্রশংসা করছেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কে প্রশংসা করবেন, কারা কী বলবেন বা এটা প্রথমবার ঘটছে— এমন কিছু মাথায় রেখে এটা করিনি আমরা। আমাদের ভাবনা ছিল যেহেতু এই ছবির সঙ্গে গ্রামের মানুষরা সাংঘাতিকভাবে যুক্ত, এবং এর প্রযোজকও তাঁরাই, তাই এর প্রথম দেখার অধিকারও তাঁদের আছে। আর এমন অতিমারীর পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে শহরে আসা সম্ভব নয়। এছাড়াও, সবসময় গ্রামকে শহরের কাছে পৌঁছতে হবে এটাই বা কেন হবে? একবার শহরও গ্রামের কাছে আসুক!”

করোনার এই পরিস্থিতিতে সমস্ত রকম ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে আড়ংঘাটা ফুটবল মাঠে। “মাঠটা এমনিতেই অনেকটা বড়ো, কাজেই সোশ্যাল ডিসটেন্স বজায় রেখেও লোকে ভালোভাবে বসতে পারবে। প্রোজেক্টরের মাধ্যমে সিনেমাটি দেখানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই পুরো ব্যাপারে ওখানকার পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকে যাতে মাস্ক পরে, স্যানিটাইজার নিয়ে মাঠে ঢোকেন সেই কথা বলা হয়েছে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সিনেমাটি দুবার প্রদর্শনের কথাও মাথায় রাখা হয়েছে”, জানালেন সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি। আপাতত এখন অপেক্ষার সময়। অপেক্ষায় গোটা আড়ংঘাটা গ্রাম। তারিখ ওই একই— ২০ অক্টোবর, আড়ংঘাটা ফুটবল খেলার মাঠে, সন্ধে ৬টায় হাজির হবে ‘দুধ পিঠের গাছ’…

আরও পড়ুন
প্রযোজনার দায়িত্বে গ্রামবাসীরাই; অসংখ্য রূপকথাকে এক সূত্রে বেঁধে দেয় ‘দুধ পিঠের গাছ’

Powered by Froala Editor

More From Author See More