পরাধীনতার হতাশা মণ্ডপজুড়ে, সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে সেই প্রথম থিমপুজো কলকাতায়

১৯৩৮ সাল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র তখন রাজনৈতিক জীবনের মধ্যগগনে। কখনো কোনো কারখানা উদ্বোধনের ডাক আসে তো কোথাও কোনো সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ। এমন সময় একটি দুর্গাপুজো কমিটি থেকে ডাক এল সভাপতি হওয়ার। কিন্তু এইবার একটু যেন কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখা গেল সুভাষের মধ্যে।

১৯৩১ সাল থেকেই শুরু হয়েছে কুমারটুলি সর্বজনীনের দুর্গাপুজো। একদিকে এখানকার শিল্পীদের নিয়েই গড়ে ওঠা এই পুজো। একেবারে বিশ্বকর্মার সন্তানদের হাতের ছোঁয়া পুজোর সর্বাঙ্গে। কিন্তু সমস্যা একটাই পুজোর মূল উদ্যোক্তার নাম স্যার হরিশঙ্কর পাল। নামের আগের উপাধি দেখেই বোঝা যায় ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিশেষ হৃদ্যতার। আর তাই এই পুজোয় সভাপতি হতে প্রথমে নাকি রাজি হননি সুভাষচন্দ্র বসু। পরে অবশ্য অনেক পীড়াপীড়িতে রাজি করানো হয় তাঁকে।

সভাপতি হলেও কিন্তু সুভাষচন্দ্র প্রথমেই বললেন, এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে প্রমাণ হয় এই দুর্গাপুজো ব্রিটিশদের আনুগত্য মেনে চলে না। যেমন দাবি, তেমনই এগিয়ে এলেন শিল্পীরা। সারা মণ্ডপ সেজে উঠল দেশের পরাধীনতার যন্ত্রণার ছবিতে। আর সেইসঙ্গে অবশ্যই স্বাধীনতার আহ্বান। দুর্গাপুজোয় সেই প্রথম থিম পুজোর প্রচলন হল।

পুরনো দিনের এইসব কাহিনি বলতে বলতে কেমন অন্যমস্ক হয়ে পড়েছিলেন পুজোর বর্তমান আহ্বায়ক দেবাশিষ ভট্টাচার্য। হঠাৎ বলে ওঠেন, “এখন অনেকে থিম পুজোর মধ্যেও সাবেকিয়ানার ফিউশন নিয়ে আসার কথা বলছে। বলছে এটাই নাকি ঐতিহ্য। ঐতিহ্য তো ইতিহাসের মধ্যেই থাকে। কুমারটুলির ঐতিহ্য কিন্তু থিম পুজোতেই।”

১৯৩৮ সাল কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। পুজোর সমস্ত আয়োজন প্রায় শেষ। প্রতিমার শুধু চক্ষুদান বাকি। পরের দিন বোধন। এমন সময় হঠাৎ আগুন লেগে গেল কোনোভাবে। মণ্ডপের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও প্রতিমা সম্পূর্ণ পুড়ে গেল। এবার পুজো হবে কী করে? সুভাষ বললেন, তিনি সভাপতি থাকাকালীন এভাবে পুজো আটকে যাবে? এটা মেনে নেওয়া যায় না। ডাক পড়ল শিল্পীদের সবার কাছে। যেমন করে হোক, এক রাতের মধ্যেই গড়ে তোলা চাই প্রতিমা। যেমন বলা, তেমনই শুরু হল কাজ। দায়িত্ব নিলেন কুমারটুলির শিল্পীদের প্রবাদপ্রতিম মানুষটি। তাঁর নাম গোপেশ্বর পাল। আজও অবশ্য জি. পাল নামেই বেশি পরিচিত তিনি।

শিল্পী গোপেশ্বর পাল (বাঁদিকে শিল্পকর্ম এবং ডানদিকে শিল্পী)

 

সেবার কিন্তু একরাতের মধ্যে প্রতিমা তৈরি করতে কাজকে ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে দিলেন গোপেশ্বর পাল। একচালার প্রতিমার পরিবর্তে তৈরি হল পাঁচচালা প্রতিমা। সেটাও সেই প্রথম। আর এরপর কুমারটুলি সর্বজনীনে কখনো একচালা প্রতিমার পুজো হয়নি।

গোপেশ্বর পাল যে প্রতিমার নির্মানশৈলী শুরু করেছিলেন, তাকেই পরবর্তীকালে আরও এগিয়ে নিয়ে যান যতীন পাল। প্রতিমার চেহারা বাস্তবানুগ হওয়া উচিৎ বলেই মনে করতেন তিনি। মানুষ দিব্যি চিড়িয়াখানায় গিয়ে কেশরসুদ্ধ সিংহ দেখে আসবেন, আর পুজোর প্রতিমায় তার চেহারা দেখবেন ঘোড়ার মতো, এমনটা চলতে পারে না। ব্যস্, খানিকটা মাংস নিয়ে চললেন চিড়িয়াখানা। সিংহের খাঁচার মধ্যে ছুঁড়ে দেন। আর সেই ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য খাতায় স্কেচ তুলতে থাকেন। যেন মহিষাসুরের বুকের উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই সিংহ। মহিষাসুরের চেহারা তৈরির জন্য নাকি ব্যায়ামবিদ মনতোষ রায়কে ঠায় বসিয়ে রেখেছিলেন মডেল হিসাবে।

৯০তম বছরে পড়ল কুমারটুলি সর্বজনীনের পুজো। কিন্তু তার ঐতিহ্য এখনও সমানে চলেছে। আহ্বায়ক দেবাশিষ ভট্টাচার্য বলছিলেন, “শিল্পীদের নিজেদেরই তো পুজো। তাঁরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ শিল্পটা এখানেই তুলে আনবেন, তাতে আশ্চর্যের কী?” মণ্ডপসজ্জা নয়, এখনও প্রতিমাতেই জোর দিয়ে চলেছেন শিল্পীরা। আর এই মহামারী পরিস্থিতিতে মা সেজে উঠবেন অভয়া রূপে। “এই মহামারীর মধ্যেও দুর্গাপুজো তো আমাদের অভয়দান করছেই। সেই বাস্তবকে তুলে ধরেছেন শিল্পীরা।” বলছিলেন দেবাশিষ ভট্টাচার্য। যদিও এবারে মণ্ডপের আকার অনেক ছোটো, বেশি দর্শনার্থীর ভিড়ও কাঙ্খিত নয়। কিন্তু ইতিহাস আর বর্তমানের মেলবন্ধনের সাক্ষী থাকতে কুমারটুলি সার্বজনীনে যে একবার আসতেই হবে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More