চৈত্রের শেষ দিনে চড়ক পূজা শুরু হয় আর বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে নাকি পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল।
আর তাই চড়ক পূজা কবে কীভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কখনও রাজ-রাজড়াদের পূজা ছিল না। এটি ছিল হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি। পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের কথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক। তাই এ পূজায় এখনও কোন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়ে না।
এ পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
পূজার উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।
হিন্দু ধর্ম মতে চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম পর্যন্ত ভক্তরা মহাদেব শিবঠাকুরের আরাধনা করতে থাকেন। মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানান পূজার আয়োজন করেন তারা। ফলপূজা, কাদা পূজা, নীল পূজাসহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজা পালন শেষে আয়োজন করা হয় গা শিউরে উঠা চড়ক পূজা।
চড়ক পূজায় পিঠে বাণ ফুড়িয়ে চড়ক গাছের সঙ্গে বাশঁ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের চড়কায় ঝুলন্ত দড়ির সঙ্গে পিঠের বড়শি বেঁধে দেওয়া হয়। তখন বাণ বিদ্ধ সন্ন্যাসীরা শূন্যে ঝুলতে থাকেন। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা উপোস থাকেন। পরদিন বিকেলে এ চড়ক পূজা শেষেই উপোস ভাঙেন তাঁরা।
চড়ক পূজার শুরুতে শিবপাঁচালী পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন তারা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা (শিবপাঁচালী পাঠক)। সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রমাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূন্যে ঘুরতে থাকেন। আবার সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ ও করেন। এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছেটান এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। তাদের বিশ্বাস জগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
এই দিনেই কলকাতার লোহাপটি থেকে বার হত বারোয়ারি সঙ। কলকাতাতে সঙদের আবির্ভাব হয় বাবুকালচারের সময় থেকে। নানারকম পোশাক ও রঙিন সাজে সেজে, গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্টি করা হত হাস্যরস। মূলত গ্রামীণ লোকেদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি হলেও, সময়ের সাথে সাথে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে এটি চলে আসে শহরাঞ্চলে। অন্যান্য পূজা-পার্বণে সঙ দেখা গেলেও, গাজন উপলক্ষে এদের সবথেকে বেশি দেখা যেত। প্রথমদিকে প্রান্তিক সমাজের সংস্কৃতি বলে, শহুরে সমাজ এটাকে নিচু চোখে দেখতো। পরে ফূর্তিবাজ জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সেই সময়ে কলকাতার এলাকা বা পাড়াগুলোয় বসতি গড়ে উঠেছিল একই জীবিকা বা একই জাতের মানুষের একত্রিত হওয়ার ভিত্তিতে। যেমন ডোমতলা, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরীটোলা, কাঁসারীপাড়া, জেলেপাড়া, লোহাপটি ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতক থেকেই কোলকাতা ও হাওড়াতে এই পাড়াগুলো থেকে, অঞ্চলভিত্তিক সঙদের শোভাযাত্রা বেরোতে থাকে। কাঁসারীপাড়া অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি তারকনাথ প্রামাণিক, এবং হিন্দু পেট্রিয়ট এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় বের হত কাঁসারীপাড়ার প্রসিদ্ধ সঙ যাত্রা, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন। পরবর্তীকালে অবশ্য আহিরীটোলা, খিদিরপুর, বেনিয়াপুকুর, তালতলা, জেলেপাড়া প্রভৃতি এলাকা থেকেও শুরু হয় সঙ বেরনো। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর থেকেও বের হতে এই সঙ। নানান এই বিচিত্র সঙের ফিরিস্তি দিয়েছেন হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমের লেখা পড়লে মনে হয় সেকালের কলকাতার সংস্কৃতি যেন সঙের রঙ ঢং-এ মেতে উঠেছে। রঙ্গময় এই বঙ্গদেশে উনিশ শতকে সঙের মিছিলে, এবং সঙের গানে রস পরিহাস ও কৌতুকে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য কথা।
সেই দিনে কোলকাতার গলি ও রাজপথের বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। কলকাতা হয়ে উঠত মিলন মেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর সামিয়ানা টাঙানো হত।
১৯১৭ সালে চুরি গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। জেলেপাড়ায় রচিত হল –
“বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে
সখীরা নেকী নাকি পড়ল ফাঁকি
কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে
বিদ্যা সর্ববিদ্যা অধিকারী
দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী
বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে”
ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষক বাঙালী বাবুদের উদ্দেশ্যে লেখা-
“ডাণ্ডা ধরে গাধা পিটলে
ঘোড়া কভু হয় না
ধরে যখন কান মলা দেয়
তখন বাঁকা থাকতে পারে না।”
তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গান —
“এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপ
চোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপ
মুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপ
একমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যান
এরা নতুন অর্থ করেন গীতার
ভুল ধরেন পরম পিতার
নৈলে কি তার trial বিনা in হয়।”
হাসির, হাসানোর নানা রঙ ঢং দেখিয়ে সঙ ছড়া কাটত —
“হাসি হাসব না তো কি
হাসির বায়না নিয়েছি
হাসি ষোল টাকা মণ
হাসি মাঝারি রকম
হাসি বিবিয়ানা জানে
হাসি গুড়ুক তামাক টানে
হাসি প্যরা গুড়ের সেরা
হাসি হুজুর করে জেরা।”
তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যে সব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। এরকম তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির উপরে বিদ্রুপ করার জন্য, একটা সামাজিক ঝড় ওঠে, এবং এই সঙ সংস্কৃতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপে এবং কোলকাতাতে প্লেগের মহামারীর জন্য, এই সঙযাত্রা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, ১৯৯৩ সালে আবার নতুন উদ্যোগে জেলেপাড়ার সঙ শুরু হলেও, সেটা আর আগের মতো প্রসিদ্ধি পায়নি, কারণ সময়টা বদলে যেতে শুরু করেছিল অনেকটাই। বিশ্বায়নের যুগে, এই সঙ-সংস্কৃতির আর কোনো চাহিদা তৈরী হয়নি।
এই সঙ-সংস্কৃতি কোলকাতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেলেও, তাদের ছড়া-গানের এবং যাত্রার নামের অনেকগুলো কথা এখনো আমরা ব্যাবহার করে থাকি। যেমন-
‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’,
‘বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’,
‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’,
‘খ্যাঁদা পুত্রের নাম পদ্মলোচন’,
‘মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়’।
এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতা তথা জেলেপাড়ার সঙ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ৮০’র দশকে ‘কলিকাতা কৈবর্ত সমিতি’ আবার নতুন ভাবে উপস্থাপিত করে জেলেপাড়ার সঙকে। প্রতিবাদ জানানো হয় দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। ১৯৯৩ সালে ডঃ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে আবার শুরু হয় জেলেপাড়ার সঙ সমিতি সঙ্ঘ, মিছিল বের করেন শঙ্কর প্রসাদ দে। এঁদেরই মতো কিছু মানুষের উদ্যোগে আজও বেঁচে আছে বাংলা লোক বিনোদনের এই মৃতপ্রায় মাধ্যমটি।
Powered by Froala Editor