মিশরের ‘সোনার শহর’-এর অলিগলিতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা, উঠে আসছে অজানা তথ্য

একবার যা আবিষ্কার হয়েছে, তা পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব নয়। অন্তত এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তো নয়ই। তাই কয়েক দশক আগেই মিশরের ‘সোনার শহর’ আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে যে গুজব সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে চলেছে, তার কোনো ভিত্তি নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন মিশর বিশেষজ্ঞ জাহি হাওয়াস। সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল লুক্সর শহরের দক্ষিণে একটি ৩ হাজার বছরের প্রাচীন শহর উদ্ধার করেছেন। শুধুই একটি প্রাচীন শহর নয়, সম্ভবত সেই সময়ের পৃথিবীর বৃহত্তম শহরটির সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা। তবে ঐতিহাসিকদের কাছে এই শহরের গুরুত্ব আরও কিছুটা বেশি। এক শতাব্দী আগে হাওয়ার্ড কার্টারের নেতৃত্বে তুতেনখামেনের সমাধি উদ্ধার যদি মিশর গবেষণার সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার হয়, এটি নিঃসন্দেহে দ্বিতীয়। এমনটাই জানাচ্ছেন হাওয়াস।

২০২০ সালের গোড়াতে ফ্যারাও তৃতীয় রামশের কীর্তি অনুসন্ধানের জন্য খননকার্য চালাচ্ছিলেন একদল প্রত্নতাত্ত্বিক। কিন্তু তার বদলে যা পেলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। মিশরের নানা প্রাচীন লিপিতে এই শহরের কথা ঐতিহাসিকরা জানতে পেরেছিলেন আগেই। খননকার্য যত এগোতে থাকে, ততই ঐতিহাসিকরা নিঃসন্দেহ হতে থাকেন এই আবিষ্কারের বিষয়ে। জাহি হাওয়াস জানিয়েছেন, মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় সময় অষ্টাদশ সাম্রাজ্যের সময়। ফ্যারাও তৃতীয় আমেনহোতেফের রাজত্বে মিশর তখন সমসাময়িক সমস্ত সভ্যতাকে টেক্কা দিতে প্রস্তুত। আর সেই কীর্তিকে চিরস্থায়ী করতেই এক বিরাট শহর তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। মিশরের ইতিহাসে এই শহর ‘সোনার শহর’ নামে পরিচিত। তবে এল-ডোরাডোর মতো কিছু নয়।

তবে এতদিন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের কাছে এই শহর নিয়ে প্রায় কোনো তথ্যই ছিল না। শুধু এই শহর নয়, আমেনহোতেফের রাজত্বের সময় মিশরের সংস্কৃতির সামান্যই আভাস পাওয়া যায়। তাঁর নাতি নাবালক ফ্যারাও তুতেনখামেনের বিষয়ে অবশ্য বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। তার বেশিরভাগটাই হাওয়ার্ড কার্টারের অনুসন্ধানের সূত্র ধরে। তুতেনখামেন নিজেও এই শহরে রাজত্ব করেছেন। তবে সেই সময়ের ইতিহাস এখনও রহস্যে ঢাকা। লুক্সর শহরের দক্ষিণে সন্ধান পাওয়া এই নতুন প্রত্নক্ষেত্র সেই অন্ধকার অনেকটাই উন্মোচন করবে বলে মনে করছে জাহি হাওয়াস। ইতিমধ্যে অবশ্য খুব কম প্রত্নসামগ্রীই চিহ্নিত করা গিয়েছে। সমস্ত শহর পরিমাপ করে পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এই মানচিত্র তৈরি হলে প্রাচীন মিশরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এক বিস্ময়কর নিদর্শনের কথা জানতে পারবেন বিশ্ববাসী। এমনটাই জানাচ্ছে ডঃ হাওয়াস। সমগ্র শহরের পরিকল্পনা, নিকাশি ব্যবস্থা, গঠনকাঠামো মুগ্ধ করেছে তাঁকে। তিনি জানিয়েছেন, শহরটিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন মিশরবাসী। একটি ছিল প্রশাসনিক অঞ্চল। অন্য একটিতে থাকতেন দাস ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষরা। আর তৃতীয় অঞ্চলটি জুড়ে ছিল কারখানা ও কৃষিজমি। এছাড়াও একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে ছিল মাংস সংরক্ষণের কেন্দ্র।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছেন বেশ কিছু খাবার পাত্র ও অন্যান্য মৃৎসামগ্রী। প্রতিটা পাত্রে ভিন্ন ভিন্নখাবার পরিবেশন করা হত। সেইসব খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে আরও বিশদে জানার জন্য গবেষণা চলছে পরীক্ষাগারে। ইতিহাসের দিক থেকে তো বটেই, ইজিপ্টের অর্থনীতিতেও এই আবিষ্কার বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। দেশের জিডিপির অনেকটাই নির্ভর করে পর্যটন শিল্পের উপরে। তবে করোনা অতিমারীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেই অর্থনীতি। নতুন করে পর্যটন শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এই সময় নতুন আবিষ্কৃত এই প্রত্নক্ষেত্র বহু মানুষকে আকর্ষণ করবে বলে আশাবাদী মিশর সরকার। তবে পর্যটনের কারণে কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে প্রশাসনকে। ইতিমধ্যে সেই অনুরোধ জানিয়েছে জাহি হাওয়াস এবং তাঁর সহকর্মীরা।

আরও পড়ুন
সর্বকালের অন্যতম প্রত্ন-আবিষ্কার মিশরে, উদ্ধার ৩ হাজার বছরের প্রাচীন শহর

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রকাশ্য রাস্তায় ফ্যারাওদের মিছিল! বিরল আয়োজন মিশরে