তাঁর কাছে হাতেখড়ি একাধিক অলিম্পিয়ানের, প্রয়াত ‘দ্রোণাচার্য’ সঞ্জয় চক্রবর্তী

২০১৭ সালের আগস্ট মাস। প্রকাশিত হল দ্রোণাচার্য পুরস্কারের তালিকা। সেখানে সেদিন জ্বল জ্বল করছিল এক বাঙালি ক্রিড়া-প্রশিক্ষকের নাম। সঞ্জয় চক্রবর্তী। শুটিংয়ের তিন দ্রোণাচার্যের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব তিনি। কিন্তু ক্রীড়াজগতের বাইরে ক’জন বাঙালি অবগত ছিলেন সেদিন এই খ্যাতনামা শুটিং কোচের সম্পর্কে? অথচ ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁকে কিংবদন্তি বলাই চলে। এক-দু’জন নয়, পাঁচজন অলিম্পিয়ান তারকাকে তুলে এনেছিলেন তিনি। যা এক আশ্চর্য কৃতিত্ব। 

কয়েক বছর আগে থেকেই শরীরে বাসা বেঁধেছিল দুরারোগ্য ক্যানসার। তবে ক্রমশ সুস্থতার দিকেই ফিরছিলেন তিনি। কিছুদিন আগে তিনি আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। সেই ধাক্কাটাই আর সামলে নিতে পারলেন না। ঘাতক হয়ে দাঁড়াল কোমর্বিডিটি। ঘড়িতে তখন রাত সোয়া দশটা। গতকাল মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সঞ্জয় চক্রবর্তী। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। 

বাঙালি হলেও সঞ্জয় চক্রবর্তীর জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠে— সবটাই উত্তরপ্রদেশে। পড়াশোনা শেষ করে নৌবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। বন্দুক চালনায় হাতেখড়ি সেখানেই। বয়স তখন প্রায় তিরিশ ছুঁই ছুঁই। যৌবনের সায়হ্নে এসে, প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন সঞ্জয় চক্রবর্তী। পরবর্তীতে স্যাফ-সহ একাধিক জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলেছেন তিনি। সেরা খেলোয়াড় হিসাবে পেয়েছেন ছত্রপতি শিবাজী পুরস্কার।

তবে ক্রীড়াজীবন থেকেই তাঁর অন্যতম আকর্ষণের জায়গা ছিল কোচিং। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর বেছে নেন প্রশিক্ষকের ভূমিকাকেই। লক্ষ্য ছিল, তরুণ প্রতিভাদের তুলে আনা। তবে নিজের কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাডেমি ছিল না। বেতন নিয়েও ছিল না কোনো মাথাব্যথা। শুধুমাত্র ভালোবাসার জায়গা থেকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই জীবন। শেষ বয়সেও নিয়মিত হাজির হতেন শুটিং রেঞ্জে। শারীরিক ভারসাম্য আর একাগ্রতাই যে শুটিংয়ে সাফল্যের চাবিকাঠি— সেই জাদুমন্ত্রেই তিনি দীক্ষিত করতেন শিক্ষার্থীদের।

আরও পড়ুন
‘বাবু পেলে ছবি বানাব, এখন লক্ষ্য বিজেপিকে হারানো’, বলছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্জুন

অঞ্জলি ভগবত, গগন নারাং, সুমা সুরুর, অয়নিকা পাল ও দীপালি দেশপাণ্ডে— এই পাঁচ অলিম্পিয়ানই দীক্ষিত সঞ্জয় চক্রবর্তীর কাছে। আশ্চর্যের বিষয় অয়নিকা ছাড়া বাকি চারজনই পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। অঞ্জলি এবং গগন নারাং পেয়েছেন রাজীব গান্ধী খেলরন্তও। মুম্বাইয়ে সঞ্জয় চক্রবর্তীর হাত ধরেই উঠে এসেছিল তিন প্রজন্মের শুটাররা। তাঁর শিক্ষার্থীরা ভারতকে এনে দিয়েছে বিশ্বকাপ, কমনওয়েলথ গেমস-সহ শতাধিক আন্তর্জাতিক মেডেল। তবে বিনয়ী শুটিং কোচ চিরকালই এই কৃতিত্বের মুকুট পরিয়েছেন নিজের শিক্ষার্থীদের মাথায়। তিনি কেবল পর্যবেক্ষক-মাত্র, এমনটাই দাবি ছিল তাঁর। শুধু আক্ষেপ ছিল একটাই। ভারতের জাতীয় দলের কোচ হিসাবে বহুবার বিদেশ সফরে গেলেও, কোনোদিন অংশ হতে পারেননি অলিম্পিকের।

তবে শুধু প্রশিক্ষাই নয়, শুটিং প্রশিক্ষণের পরিকাঠামো গড়ে তোলাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে তাঁর। মুম্বাইয়ে মহারাষ্ট্র রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনে ১০ মিটার শুটিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠার পিছনেও অন্যতম অবদান ছিল তাঁর। 

আরও পড়ুন
একলব্যকে হত্যার আদেশ দিলেন বিদুর, ভীত দ্রোণাচার্য

অবশেষে পাঠশালা বন্ধ করলেন তিনি। নীরবেই পাড়ি দিলেন এক অন্য জগতে। শেষ হল আধুনিক শুটিংয়ের এক দীর্ঘ অধ্যায়। তাঁর এই চলে যাওয়ায় এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হল নিঃসন্দেহে। তবে তরুণ প্রজন্মকে দূরদর্শিতার স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর ব্যাটন এবার হাতে তুলে নেওয়ার পালা তাঁর তৈরি মণিমুক্তোদেরই…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তাস খেলেই দেশে এনেছেন স্বর্ণপদক, এবার অর্জুন পুরস্কারের দৌড়ে দুই বাঙালি