বয়স মাত্র ১৭ বছর; ভারতের স্কুলে তৈরি ‘রোল বল’ খেলা এখন অলিম্পিকের অপেক্ষায়

পুনের কাছেই ছোট্ট শহর কোথরুড। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগের কথা। ২০০৩ সালে এই শহরেরই ‘বালাশিক্ষন মন্দির ইংলিশ স্কুল’-এ জন্ম নিয়েছিল এক সম্পূর্ণ নতুন খেলা। নাম রোল বল। স্কুলের তৎকালীন ক্রীড়া শিক্ষক রাজু দভাদে বিভিন্ন খেলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়েই তৈরি করে বসেছিলেন এটি। তবে দক্ষিণ ভারতের স্কুলে তৈরি এই খেলাই এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশ বর্তমানে অংশ নেয় রোল বলের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে জন্ম নিল এই অভিনব খেলা? বিশেষত্বই বা কি এই রোল বলের? আসলে স্পিড স্কেটিং, হ্যান্ডবল এবং বাস্কেটবল— এই তিন খেলার সংমিশ্রণেই প্রশিক্ষক রাজু দভাদে তৈরি করেছিলেন রোল বল। মূলত স্পিড স্কেটিংয়ের কোচিং করাতেন রাজু। সেইসঙ্গে তাল মিলিয়েই একই সময়ে বাস্কেটবল আর হ্যান্ডবলের অনুশীলন চলত দক্ষিণের এই স্কুলে। অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবেই একদিন ছাত্রদের স্কেটিং বুট পরে বাস্কেটবল ড্রিবিল করার নির্দেশ দেন রাজু। তবে এই সিদ্ধান্ত একদিনের নয়। বাস্কেটবল কোচ প্রমোদ পাটওয়ার্ডনের সঙ্গে যৌথভাবে কথা বলে এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের শারীরিক দক্ষতা এবং শরীরের ব্যালেন্স বাড়ানো।

তবে অদ্ভুতভাবেই তাঁর ছাত্ররা এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে চমকে দিয়েছিল তাঁকে। আর সেখান থেকেই তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন এই খেলা তৈরির। বানিয়ে ফেলেন এই খেলার বিশেষ নিয়মাবলিও। প্রথমে শুধু স্কুলের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল এই খেলা। খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬-৭ জন। তবে পরে বাইরের স্কেটিং বা বাস্কেটবল খেলোয়াড়রাও আগ্রহ দেখান রোল বলে। ২০০৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের খেলার তালিকায় নথিভুক্ত হয় রোল বল। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দু’ হাজার খেলোয়াড় জড়িত এই খেলার সঙ্গে।

১৫ মিটার বাই ৩০ মিটার স্কেটিং কোর্টেই শুরুতে খেলা হত রোল বল। আসলে শিশু এবং কিশোর ছাত্রদের কথা ভেবেই রাজু ছোটো রেখেছিলেন মাঠের আয়তন। তবে যত দিন গড়ায় স্পষ্ট হয়ে আসে, প্রাপ্তবয়স্ক খেলোয়াড়দের জন্য বাড়াতে হবে রোল বল কোর্ট। কাজেই এই মুহূর্তে কোর্টের আয়তন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ বাই ৪০ মিটার। তবে অনূর্ধ্ব ১১ এবং ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এখনও আয়োজিত হয় পুরনো আয়তনের মাঠেই।

পাস, ড্রিবিল, থ্রো, হিট— সবকিছুই বৈধ এই খেলায়। আর সেই কারণেই রোল বলের খেলায় গোলরক্ষণ বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং। ২৫ মিনিটের দুই অর্ধে ৫০ মিনিটের ম্যাচ হয় এই খেলার। প্রতি দলে থাকে ৬ জন করে খেলোয়াড়। রিজার্ভ বেঞ্চ অতিরিক্ত আরও ছয় খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে মাঠে নামে ১২ জন সদস্যের টিম। 

আরও পড়ুন
অভিবাসীদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতেও ব্যর্থ ভারত, জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট

বর্তমানে প্রতি ২ বছর ছাড়া ছাড়াই আয়োজিত হয় রোল বলের বিশ্বকাপ। অংশ নেয় ভারত-সহ জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ডেনমার্ক, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, চিন, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, বেলজিয়াম, বাংলাদেশ, গায়ানা, উগান্ডা, নেপাল, কেনিয়া প্রভৃতি দেশ। ২০১৯ সালে রোল বলের বিশ্বকাপ জিতে পঞ্চম ট্রফি তুলে নেয় ভারত। 

তবে প্রথমদিকে এই খেলা জনপ্রিয় ছিল কেবলমাত্র পুরুষদের মধ্যেই। ২০১৩ সালে ভারতীয় মহিলা দল বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে অনেকটাই বদলে যায় পরিস্থিতি। জাতীয় এবং অঞ্চলিক দলগুলিতে সন্তানদের প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে নাম লেখাচ্ছেন অভিভাবকরা। যা সত্যিই একটি ইতিবাচক দিক নবনির্মিত এই খেলার জন্য।

আরও পড়ুন
বাঙালি স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের হাতেই তৈরি ভারতের ‘গোলাপি শহর’ জয়পুর

তবে নবনির্মিত হলেও ইতিমধ্যেই গিনেস বুকে রেকর্ড করে ফেলেছে এই খেলা। ২০১৮ সালে কর্ণাটকে আয়োজিত হয় ২৪ ঘণ্টার একটি রোল বল ম্যাচ। দিনের বেলায় সেই ম্যাচে খেলেছিলেন কিশোর খেলোয়াড়রা। অন্যদিকে রাত্রে মাঠে নেমেছিল সিনিয়র দল। যে-কোনো খেলার ইতিহাসেই সারাদিন ধরে চলা এমন ম্যাচের উদাহরণ আর একটাও নেই। সে বছর মে মাসেই এই অভিনব ম্যাচকে স্বীকৃতি জানায় গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। 

রোল বলের ঝুলিতে একদিকে যেমন রয়েছে বিশ্বকাপ, তেমনই আছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও। রাজু দভাদে তো বটেই পাশাপাশি রোল বলের আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থার বর্তমান লক্ষ্য এই খেলাকে কমনওয়েলথ গেমস এবং অলিম্পিকের অংশ করে তোলা। তার জন্যই চলছে চেষ্টা। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অলিম্পিকের মঞ্চেও মঞ্চস্থ হবে দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেওয়া এই ফিউশন-গেম...

আরও পড়ুন
ব্রিটিশ কলকাতায় নববর্ষ উদযাপন, সমুদ্র পেরিয়ে হাজির ইতালির গায়িকা!

Powered by Froala Editor

More From Author See More