অলিম্পিকে ফাইন আর্ট প্রতিযোগিতা, অংশ নিতেন দেশ-বিদেশের 'ক্রীড়াবিদ'!

অলিম্পিক— বিশ্বের ক্রীড়াক্ষেত্রের সবচেয়ে বড়ো আসর। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নামী-অনামী কত মানুষ এসে জড়ো হন এক ছাতার তলায়। সবাই যে খেলোয়াড়, তা কিন্তু নয়। টিমের সঙ্গে যুক্ত সদস্য, বিভিন্ন দেশের সমর্থকরা দল বেঁধে হাজির হন অলিম্পিকের আসরে। তারপর চলে খেলার মহাযজ্ঞ। এই ছবিটাই আমরা দেখে এসেছি আজীবন। না, ঠিক আজীবন ধরে নয়। একটা সময় সাঁতার, রাগবি, হাই জাম্পের পাশাপাশি হাজির হয়েছিল আরও একটি বিভাগ— ফাইন আর্ট! বাংলায় যাকে বলে চারুকলা!

হ্যাঁ, অলিম্পিকের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফাইন আর্টও। ১৯১২ থেকে ১৯৪৮— দীর্ঘ চার দশক ধরে একের পর এক শিল্পী (না, খেলোয়াড়?) হাজির হয়েছেন এই মঞ্চে। তুলে ধরেছেন নিজেদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলি। অঙ্কনশিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সাহিত্য, গান— কি ছিল না সেই বিভাগে! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন ছবিটা কল্পনা করা একটু অসুবিধা তো বটেই। কিন্তু সেই চারটে দশকের ছবিটা ভাবলে খানিক রোমাঞ্চ কি হয় না শিল্পী মানুষদের? খেলা, প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অদ্ভুত সব রঙের ছোঁয়ায় সেই সময়টা সেজে উঠত অলিম্পিকের ময়দান… 

শুরুর রাস্তাটা ছিল স্বপ্নের মতো। সেখানে ছিল নানা ওঠাপড়া। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ব্যারন পিয়ের ডে কুবার্তিন। নামটির সঙ্গে অল্পবিস্তর আমরা সবাই পরিচিত। পিয়ের ডে কুবার্তিনই হলেন আধুনিক অলিম্পিকের জনক। তাঁর হাত ধরেই একটি নতুন রূপ পেয়েছিল এই আসর। যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই ভদ্রলোক বেড়ে উঠেছিলেন বেশ শিক্ষিত, সংস্কৃতিপূর্ণ পরিবেশে। সেইভাবে রুচিও বেড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যখন অলিম্পিককে নতুন করে শুরু করার পরিকল্পনা করলেন, সেখানেও লেগেছিল এমন রুচির ছাপ। 

তবে পিয়ের ডে কুবার্তিনের লক্ষ্যটা আরও বড়ো ছিল। শুধু খেলা, অ্যাথলেটিক নয়; এই প্রতিযোগিতায় ছোঁয়া থাকুক শিল্পেরও। সেই ভাবনা থেকেই অলিম্পিকের ময়দানে চারুকলাকে নিয়ে আসার প্রস্তাব রেখেছিলেন কুবার্তিন। যেখানে থাকবে সাহিত্য, কবিতা, সঙ্গীত, আঁকা— সবকিছু। শরীরের পাশাপাশি মননের দিকটা নিয়েও চিন্তা করেছিলেন তিনি। নতুন সময়ের অলিম্পিক যেন সবদিকে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ভাবনা প্রথমে বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম কয়েকটি ক্ষেত্রে এই চারুকলা বা ফাইন আর্টের প্রতিযোগিতা আয়োজনই করা যায়নি। আপত্তি করেছিলেন আয়োজকরাই। এদিকে পিয়ের কুবার্তিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সবদিক থেকে। তা না হলে যে সম্পূর্ণ হবে না ‘অলিম্পিক’-এর ভাবনা… 

শেষ পর্যন্ত অনুমতি মিলল। ১৯১২ সাল। স্টকহোমে আয়োজিত হচ্ছে সামার অলিম্পিক। আর সেখানেই প্রথমবারের মতো শুরু হল চারুকলার প্রতিযোগিতা। যে কোনো বিভাগে নিজের সৃষ্টি নিয়ে আসতে পারেন প্রতিযোগীরা; তবে শর্ত একটাই। প্রতিটা কাজের মধ্যে যেন খেলা ফুটে ওঠে। প্রথমবার মোট ৩৩ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন এতে। আর এখানেই অংশ নেন ওয়াল্টার উইনানস। বিগত লন্ডন অলিম্পিকেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন; তবে সেখানে শিল্পী হিসেবে নয়, ক্রীড়াবিদ হিসেবে। ১৯০৮ এবং ১৯১২— দুটিতেই শুটিং বিভাগে পদক জেতেন তিনি। তার মধ্যে ছিল ১৯০৮-এর সোনার পদকও। তবে ১৯১২-তে তিনি হাজির হলেন আরও এক রূপে। শুটারের পাশাপাশি এখানে তিনি শিল্পী। তৈরি করেছিলেন ব্রোঞ্জের একটি মূর্তি— একটি ঘোড়া তার রথটি টানছে। আর এমন ভাস্কর্যের জন্যই তিনি জিতে নেন সোনা।

বিগত বছরগুলোতেও একইভাবে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতে থাকে। কিন্তু খানিক যেন নিষ্প্রভ। অন্যান্য বিভাগে দর্শক উপচে পড়ে স্টেডিয়ামে; আর ফাইন আর্টের প্রতিযোগিতায় সেরকম ভিড়ই হয় না। তার ওপর প্রতিযোগীদের মধ্যেও সবসময় সেরকম উৎসাহ ছিল না। যেহেতু প্রধান থিম ছিল খেলা, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাগবি বা বক্সিংয়ের কোনো ছবি, বা স্টেডিয়ামের মূর্তি তৈরি হত। পরবর্তীকালে সেগুলো যখন মিউজিয়ামে স্থান পায়, তখন দর্শকরা হাজির হন। এমন পরিস্থিতিতে, ফাইন আর্টের প্রতিযোগিতা অলিম্পিকে থাকবে কিনা, তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। 

আরও পড়ুন
২০২২ পর্যন্ত অলিম্পিক এবং ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে নির্বাসন রাশিয়ার

তবুও চলেছিল এটি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে এসে কফিনে পেরেক পড়ে। শিল্পীরাও একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলেন অলিম্পিকের মঞ্চ থেকে। তাহলে আর এগিয়ে নিয়ে কী হবে? ১৯৪৮ সালেই শেষবার আয়োজিত হল ফাইন আর্টের প্রতিযোগিতা। তারপর, ইতি। অলিম্পিক রয়ে গেছে আজও। তার উন্মাদনায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। কত ক্রীড়াবিদের অবিস্মরণীয় কীর্তি দেখেছে এই মঞ্চ। আর চারুকলা? সেটি থেকে গেছে ইতিহাসের এক অপূর্ব অধ্যায় হয়ে… 

তথ্যসূত্র- ‘When the Olympics Gave Out Medals for Art’, Joseph Stromberg, Smithsonian Magazine 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আমেরিকার অলিম্পিক দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান, চলে গেলেন কিংবদন্তি অ্যাথলিট রাফের জনসন