দিগন্তজোড়া সবুজের অভিভাবক

ধুলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে - ২৩
আগের পর্বে

দেবব্রত ঘোষ। তাঁর অলংকরণের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিলই। বছর ২৬ আগে তাঁর সঙ্গে আলাপ ‘আজকাল’-এর অফিসে। এক অনুরোধেই তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন প্রথম ছড়ার বইয়ের প্রচ্ছদ অলংকরণে। তারপর সেই ঘরই হয়ে গিয়েছিল আমার আর কিন্নরদার সন্ধেকালীন আড্ডাস্থল। তবে চিরকালই প্রচ্ছদ ও অলংকরণের বিষয়ে তিনি ছিলেন খুঁতখুঁতে এবং যত্নবান। কখনোই আত্মবিশ্বাসকে ছাপিয়ে যেত না আত্মম্ভরিতা। দেবুদার ছিল এক অদ্ভুত রসবোধও। দেশের বাড়ি বলরামপুরে গিয়ে ধূ ধূ প্রান্তরে গোধূলি দেখে দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, সেই ছবি আঁকতে না পারার অতৃপ্তিই তাড়িয়ে বেড়াবে তাঁকে।

তাঁর কথা শুরু করার আগে তাঁর কর্মস্থলের খানিক পরিচয় দেওয়া যাক।

আফগানিস্তানের পেশোয়ার থেকে শুরু হয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড যার দ্বারপ্রান্তে এসে শেষ হয়েছে, যে উদ্যানের দুই প্রান্তের দুই প্রবেশদ্বারে পৌঁছে সমাপ্ত হয় দুটি বাস রুট, ২৭৩ একর জমির উপর আজ থেকে ২৩৫ বছর আগে তৈরি সেই উদ্যানের মাইলের পর মাইল সবুজ-সাম্রাজ্যে তাঁর শাসন চলত।

হ্যাঁ! যে বাগানের ভিতরে পিচ-রাস্তাই ১৫ কিলোমিটার, জলাশয় রয়েছে মোট ২৪টি এবং এই জলাশয়গুলির মধ্যে আবার ৯টি ছোট, বড় দ্বীপ আছে— সেই ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের তিনি কিউরেটর ছিলেন। শ্রী অভয়পদ ভট্টচার্য।

গঙ্গার পাড় ধরে তৈরি সেই ঔপনিবেশিক বাগান ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনে তখনও বাঙালি বটানিস্টদের বোলবোলাও। ডঃ শ্যামল ব্যানার্জী তখন পাতার 'বাইফার্কেশন' নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছেন। আর আমাদের অভয়কাকু ব্যস্ত আছেন গোটা বাগান জুড়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। তার মধ্যে বাঁশ ও পাম প্রজাতিগুলির সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং নার্সারি-১ ও নার্সারি-২ এর অরনামেন্টাল ফোলিয়েজ এবং বোগানভিলিয়ার বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে গবেষণাই প্রধান। তবে এর বাইরেও তাঁর কাজের অন্ত ছিল না।

আরও পড়ুন
এলেবেলে নন, তিনি ‘A’লেভেলের

১৯১১ সালে দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি স্থানান্তরিত হলেও, এখানেই থেকে যায় জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় উদ্যান (ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন)। কিন্তু এই বাগানের যে কোনো প্রয়োজনে নেওয়া বড় সিদ্ধান্তের সম্মতি আনাতে হত দিল্লিতে বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিস থেকে। এ কাজটিরও দায়িত্ব ছিল অভয়কাকুর।

আমার পিতৃদেবকে বড় ভাইয়ের মতো মানতেন। হাতের উল্টোপিঠের মতো করে চিনতেন বাগানটাকে। আর জানতেনও। কোন প্রজাতির কোন গাছটি বাগানের কোনখানে আছে। সেটি কত সালে কে এনে লাগিয়েছিলেন, ঐ প্রজাতির আরো গাছ আছে কিনা, থাকলে কোথায় আছে, এইসব কিছু তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল। এই সঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে বাগানটির আয়তন ও বৈচিত্রের কথাও।

তবে যতদূর মনে করতে পারি বোগানভিলিয়া, বাঁশ ও পাম গাছের বিভিন্ন প্রজাতি ও উপপ্রজাতি নিয়েই ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের গণ্ডিটি। আর বাগানে থাকাকালীন এইসব গাছের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে তিনি বেশ কিছু মৌলিক গবেষণাধর্মী কাজও করেছিলেন।

বছরের কোন সময়ে কোন গাছের চারা হয়, বীজ থেকে না লেয়ারিং থেকে নাকি কাটিং করে

আরও পড়ুন
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন

এসব মুখস্থ ছিল তাঁর।

এগ্রিহর্টি কালচারাল সোসাইটির অ্যানুয়াল ফ্লাওয়ার শো’তে সিজন ফ্লাওয়ার সেকশানে এবং ‘স্মল গার্ডেন’ সেকশানে বটেনিক্যাল গার্ডেনের তরফে প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিতেন তিনিই। ‘স্মল গার্ডেন’ বিভাগে ইডেন গার্ডেনকে হারিয়ে কাপও জিতে নিয়ে যেতেন প্রায় প্রত্যেকবারই— হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর। এর অনেক আগে উত্তরপাড়ার ব্যানার্জী নার্সারিতে আসতেন চন্দ্রমল্লিকা ও ডালিয়ার কাটিং সংগ্রহ করতে— ডিসেম্বরের গোড়ায়। যাওয়া অথবা ফেরার পথে অবশ্যই আমাদের বাড়ি আসতেন।

গুণের সমাদর করতে জানতেন। একটি ব্যক্তিগত অথবা ততটা ব্যক্তিগত নয় এমন ঘটনার উল্লেখ করলে খানিকটা বোঝা যাবে। স্টিফানোটিস ফ্লোরিবাণ্ডা নামক সুন্দর সাদা ফুলের একটি বিদেশী লতানে গাছ বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছিল। আর আশ্চর্যের কথা, ছিল আমাদের বাড়ির বাগানেও। একদিন তাঁর অফিসে বসেই কথায় কথায় অভয়কাকু বলেছিলেন, ‘লেয়ারিং করে কিছুতেই স্টিফানোটিসের চারা করতে পারছি না। অথচ 'এক্সোটিকা' (বিভিন্ন বিদেশী গাছের কোষগ্রন্থ, গাছ করিয়েদের কাছে বাইবেল তুল্যও বলা যায়) লেয়ারিং করেই চারা করতে বলছে।’

আমি সেই মুহূর্তে কিছুই না বলে বাড়ি ফিরে সেদিনই সেরাডিক্স (গ্রোথ হরমোন) লাগিয়ে চালি টবে বালির উপর মোট ৬০টি কাটিং নামাই। আমাকে অবাক করে দিয়ে ৫২টি চারা বেঁচেও যায়। তারপর একদিন টব থেকে সব চারা ঝেড়ে থলিতে ভরে নিয়ে আমি বোটানিক্যাল গার্ডেনে। অভয়কাকু খুব খুশি হয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে ঘটনাপ্রবাহে ভুলেও গিয়েছিলাম সবটাই। কিন্তু তিনি ভোলেননি। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে ডাকে পৌঁছায় বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র প্যাডে ছাপা ভট্চাজ সাহেবের আমাকে লেখা চিঠি। কাটিং-এ চারা করার কৃতিত্বের স্বীকৃতি ও সেই চারা বোটানিক্যালকে দেওয়ার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। এমনই মানুষ ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
রক্ত যখন নীল

আর একটি কথা বলতে ভুল না হয়— তাঁর তত্ত্বাবধানেই শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রথম ভিক্টোরিয়া আমাজনিকার চারা হয়।

ভিক্টোরিয়া আমাজনিকা অর্থাৎ আমাজন অববাহিকার সেই জলজ উদ্ভিদ যার বড় গোল গোল কানা উঁচু থালার মতো পাতার উপর ৫-৬ বছরের শিশু অনায়াসে ভেসে থাকতে পারে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের রক্সবার্গ মনুমেন্ট যে মোড়ে, সেই মোড়েই রাস্তার পাশের হ্রদটিতে ভিক্টোরিয়া আমাজনিকার বাস। দূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসে এদেশের জলে pH  ভারসাম্য ঠিক করে নিয়ে দিব্য বেঁচে বর্তে আছে তারা। নিয়মিত নতুন পাতা ছাড়ছে, ফুল ফোটাচ্ছে, করছে বংশবৃদ্ধি।

কিন্তু বড় বাগানের নিঃশব্দ অবসরে এখনও তারা দুই দশক আগে অবসর নেওয়া তাদের অভিভাবককেই খোঁজে বলে মনে হয়!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অম্বুদা— যিনি একাই তিনশো