কার্টুনে ঢাকা ক্ষতস্থান, শিশুদের ভয় ঘোচাতে উদ্যোগ চিকিৎসকের

পরনে নীল অ্যাপ্রন। মাথায় নীল মেডিক্যাল ক্যাপ। গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ। দেখেই বোঝা যাবে, তিনি একজন ডাক্তার। অথচ, তাঁর কম্পিউটার টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন রঙের স্কেচপেন। আর সেখানে ঝুঁকেই তিনি এঁকে চলেছেন কমিকসের চরিত্র। নিশ্চয়ই ভাবছেন, অবসর সময় কাটাচ্ছেন তিনি? না, বিষয়টা তেমন না। এই কার্টুন আঁকা আসলে তাঁর চিকিৎসারই অঙ্গ।
রবার্ট প্যারি। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও প্রদেশের আকরন শিশু হাসপাতালে দু’দশক ধরেই চিকিৎসা করে আসছেন তিনি। শুধু একজন দক্ষ পেডিয়াট্রিক সার্জন হিসাবেই নয়, তাঁর জনপ্রিয়তা শিশুসুলভ মানসিকতার জন্যও। কথা হচ্ছিল তাঁর কার্টুন, কমিক্স চরিত্র আঁকা নিয়ে। কিন্তু কেন এমন ছবি আঁকা তাঁর? তার পিছনের গল্পটাই বা কী? সেই প্রসঙ্গেই ফেরা যাক।


মূলত খুদেরাই চিকিৎসক প্যারির রোগী। অস্ত্রোপচারের পর জ্ঞান ফিরলে শরীরে ক্ষতচিহ্ন দেখে তারা অধিকাংশই ভেঙে পড়ে কান্নায়। যন্ত্রণার সঙ্গে দোসর হয়ে বসে আতঙ্কও। আর সেদিন থেকে তাদের নজর এড়াতেই এমন অভিনব সমাধান খুঁজে বার করেছেন ডাঃ প্যারি। অস্ত্রোপচারের পর হোক কিংবা ড্রেসিং— নতুন ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় নিজের হাতে আঁকা কমিক্স চরিত্রদের দিয়েই তিনি ঢেকে দেন কচিকাঁচাদের ক্ষতস্থান।

তবে খুব একটা সহজ নয় এই কাজ। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়েই এমনটা করে থাকেন তিনি। কারণ, জল রঙ কিংবা স্কেচপেনের রঙে ব্যবহৃত রাসায়নিক কোনোভাবে ক্ষতস্থানে সংক্রমিত হলে, পরিণতি হতে পারে ভয়ঙ্কর। তবে প্যারির দক্ষ হাত, এখনও পর্যন্ত ভুল করেনি কখনও। প্রথমে ব্যান্ডেজ করে, তার ওপরে পাতলা প্লাস্টিকের মেডিক্যাল টেপ দিয়ে তিনি আটকে দেন কার্টুনের কাটআউটগুলি। সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই, তিনি সেগুলি আঁকেন স্পঞ্জজাতীয় পদার্থের ওপরে। যাতে কোনোভাবেই না ছড়িয়ে পড়তে পারে রাসায়নিক রং।

আরও পড়ুন
কার্টুনের জন্য এসেছে হুমকি-ফোনও, ঝুঁকি নিয়েই রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন ‘ভট্টবাবু’

কিন্তু এই ছবি আঁকার আগেও রয়েছে তাঁর চিকিৎসা-পর্বের একটি দীর্ঘ অধ্যায়। শুরুতে রোগীর পরীক্ষানিরীক্ষার পর, তাঁদের সঙ্গে রীতিমতো ভাব জমিয়ে নেন প্যারি। গল্পের ছলেই জেনে নেন তাঁদের পছন্দের কার্টুন চরিত্র, প্রিয় খাবার, গাড়ি কিংবা খেলনার কথা। সেই মতো মনে মনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে নেন তিনি। তারপর আসল কাজ। তবে অবাক করার বিষয়, ব্যান্ডেজ করার মাঝে এই ছবি আঁকতে তিনি বড়োজোর সময় পান পাঁচ থেকে দশ মিনিট। তার মধ্যেই দ্রুততার সঙ্গে আঁকা শেষ করে সেই ছবি বসাতে হয় ব্যান্ডেজের মধ্যে।

আরও পড়ুন
রানির পদতলে রাজপরিবারের মেগান, শার্লে এবদো-র কার্টুনে ফ্লয়েডের ছায়া

আরও পড়ুন
সমাজের গালে থাপ্পড় মারতে কার্টুনই হাতিয়ার গগনেন্দ্রনাথের

চিকিৎসক প্যারি জানান, চিত্রশিল্পী ছিলেন তাঁর মা। তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত হন তিনি। অথচ প্রথাগতভাবে কোথাও আঁকা শেখেননি এই পেডিয়াট্রিক চিকিৎসক। কলেজে পড়াকালীন সময়ে, প্র্যাকটিস করতে গিয়েই তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল ছোট্ট শিশুদের আর্তনাদে। আর তখন থেকেই চেপে বসেছিল ভাবনা— কীভাবে তাদের মনযোগ সরানো যেতে পারে ক্ষতস্থান থেকে? শেষ পর্যন্ত ছোটবেলার ‘হবি’-র কাছেই শরণাপন্ন হন প্যারি। আর তাতে যে একশো শতাংশ সফল তিনি, সন্দেহ নেই কোনো।

১৯৯৬ সাল থেকেই এই পন্থা ব্যবহার করে আসছেন প্যারি। কেটে গেছে প্রায় ২৫ বছর। প্যারির আঁকা কার্টুনই এখন ওহিও’র এই হাসপাতালের ট্রেডমার্ক। এখনও পর্যন্ত তিনি ১০ হাজারেরও বেশি শিশুর অস্ত্রোপচার করেছেন। তাদের কেউ কেউ এখন প্রাপ্তবয়স্ক। হামেশাই তাঁদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে ডাঃ প্যারির বন্ধুসুলভ আচরণের কথা। কেউ অকপট স্বীকার করে বসেন, তাঁদের নিজেদের বয়স বাড়লেও এখনও রোগীদের সমবয়সিই রয়ে গেছেন ডাঃ প্যারি। কথায় রয়েছে ‘পেন ইজ মাইটার দ্যান দ্য সোর্ড’। তবে ওই ‘সোর্ড’-এর জায়গায় ‘স্ক্যালপেল’-ও যে ফিট করে যেতে পারে স্বাচ্ছন্দে— তারই নতুন করে প্রমাণ দিচ্ছেন মার্কিন চিকিৎসক…

Powered by Froala Editor