'মিনি লন্ডন অফ ইন্ডিয়া' ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সঙ্গে জুড়ে আছে বিলিতি রূপকথাও

‘পালামৌ এর পথে’ পড়েছি উচ্চমাধ্যমিকে। বুদ্ধদেব গুহর লেখায় জেনেছিলাম কেচকি, বেতলা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কথা। ট্রেনে থেকে নেমে দেখলাম আমার স্বপ্নের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশন। স্টেশনের প্লাটফর্মে হলুদ বোর্ডের মধ্যে কালো কালি দিয়ে লেখা অদ্ভুত একটা ইংরেজি বানান। নির্জন হ্যামলেট’ এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম নেই। একটা টিকিট কাউন্টার, তাও গাড়ির সময় দেখে খোলে। সারাদিন কত না মালগাড়ি উদ্দেশ্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। দু চারজন আদিবাসী লোক নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছে। আমাদের জন্য ইরশাদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করার কথা স্টেশনের বাইরে। ও বলেছিল ট্রেন থেকে নেমে বাঁ হাতটা ধরবেন। আমরা ধীর পায়ে লাইন পেরিয়ে উল্টো পাড়ে গেলাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। গাছের শুকনো পাতা অবিরাম ঝরে জানান দিচ্ছে শীত শেষে বসন্ত আর বেশি দূরে নেই। দূরের জঙ্গলে পলাশের লাল ছোঁয়া। আর সেই রং ছড়িয়ে পড়েছে আদিবাসী মেয়ের খোঁপার ফুলের সাজে। গাড়ির কাছে যেতেই ইরশাদ নেমে এসে আমাদের রুকস্যাকগুলো গাড়ির ডিকিতে তুলে দিল। গাড়ি এগিয়ে চলল। ফুরফুরে হাওয়ায় মহুয়ার গন্ধ মাদকের মতো। মনে পড়ে যাচ্ছে বুদ্ধদেব গুহর ‘একটু উষ্ণতার জন্য’র সেই বিখ্যাত ভাষ্য- “এই জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে। অনেক শিশিরঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে, অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা-গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে।”

আজ সকাল রাঁচি থেকে চোপানগামী একটা এক্সপ্রেসে উঠে পড়েছিলাম, বারোটা নাগাদ ম্যাকলস্কিগঞ্জে নামিয়ে দিল। রাচি থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে ১১৪৪৮ আপ শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস ধরে সরাসরি ম্যাকলাস্কিগঞ্জে পৌঁছনো যায় রাত ১২টা নাগাদ। হোটেলে বলে রাখলে গাড়ি পাঠিয়ে দেয় স্টেশনে। তবে নির্জন এই জায়গায় রাতের ট্রেনে সমস্যা হতে পার। প্রায়শই লেট ট্রেন।তাই এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। হাওড়া থেকে রাঁচি এসে আমাদের মতো ট্রেনে চেপে বা গাড়ি নিয়ে পৌঁছনোটাই নিরাপদ। যদিও রাঁচি থেকে ম্যাকলস্কি আসার ট্রেন খুবই সীমিত। যাঁরা শহরের কোলাহল থেকে দূরে নির্জনতার মধ্যে কয়েকটি দিন কাটাতে চান তাঁদের স্বর্গরাজ্য রাঁচি শহর থেকে মাত্র ৬০ কিমি দূরে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। চারিদিকে ছোটো ছোটো পাহাড়, ছোটো ছোটো নদী, আর আছে মহুয়া টাঁড়ের জঙ্গল। 

সেই সময় সারা দেশে হৈ-হৈ করে রেল লাইন পাতা হচ্ছে। প্রচুর জমির দরকার সারাদেশে। ব্রিটিশরা জমি অধিগ্রহণ আইন করে রেলের জন্য জমি নিচ্ছে। ছোটনাগপুর অঞ্চলে নাকি প্রচুর খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। দামোদরের উপত্যকায় নাকি প্রচুর কয়লার ভাণ্ডার। শ্রীকৃষ্ণের এক নাম দামোদর। যার নাকি উদরে (পেটে) দাম আছে, মানে অঙ্গার আছে। খনিজ সম্পদ রেলে বহন করে বন্দরে অব্দি নিয়ে আসতে হবে। তারপর সেই খনিজ সম্পদ জাহাজে করে বিদেশে পাড়ি দেবে। সাংঘাতিক মুনাফা সেই ব্যবসায়। বিভিন্ন বিলেতি কোম্পানির মধ্যে রেষারেষি লেগে গেল খনি ইজারা নেওয়ার। পৃথিবী জুড়ে লোহার চাহিদা বেড়েছে। লৌহ আকরিক গলিয়ে লোহা বের করতে প্রচুর কয়লার দরকার। তাই খনি এলাকা দিয়ে একটা লাইন পাতার চিন্তা ভাবনা সাহেবদের মাথায় এল। গোমো থেকে লাইন পাতা শুরু হয়ে ডাল্টনগঞ্জ ছুঁয়ে ডেহেরি অবধি। এই লাইনটাকে রেলের লোকেরা বলে সি আই সি সেকশন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে রেল লাইন। আগে রেলের স্লিপার কাঠের হত। প্রচুর কাঠের চাহিদা বেড়ে গেল। জঙ্গলের প্রচুর গাছ কাটা পড়ল। কলকাতা থেকে বাঙালি বাবুদের কাঠের স্লিপারের বরাত দেওয়া হল। এই ফাঁকে কিছু বাবু আর্থিক দিক দিয়ে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেল লাইন পাতার কাজ চলছে পুরোদমে। সাহেবরা বাঙালি বাবু আর বিহারি কুলিদের নিয়ে ঘন জঙ্গল কেটে রেল লাইন পেতে চলেছে মাইলের পর মাইল। জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা সাহেবদের বেশ ভালো লাগল। ঠিক ইংল্যান্ডের মতন পরিবেশ কিছুটা। আবহাওয়া সারা বৎসরই বেশ মনোরম। বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। জায়গাটা ঠিক বিলেতের মতন। মালভূমি অঞ্চল। চারিদিকে উঁচু নিচু জমি। ছোটোছোটো পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর জায়গা। সাহেবদের ঘরোয়া টেবিলে জায়গাটা একটা আলোড়ন তুলল। এ যেন মিনি লন্ডন অফ ইন্ডিয়া।

সময়টা ৩০-এর দশক। গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার দাবিতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার মেয়র পদ ছেড়ে জাতীয় যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। গান্ধীজি শুরু করেছেন অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন, লবণ সত্যাগ্রহ। রেলপথের বিস্তার ঘটছে সারা দেশে। লাহোর থেকে ঢাকা, মুম্বাই থেকে মাদ্রাজ স্টিম ইঞ্জিন ছুটছে, দেশের এক প্রান্তের খবর আরেক প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে দু-এক দিনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকায়নি তখনও। ইংরেজ শাসকও আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছে যে এদেশের তখত্ আর বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। এদিকে বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডের অর্থনীতির কোমর আস্তে আস্তে ভাঙছে। কলকাতার সাহেব কোম্পানির অফিসের ঝাঁপি আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। এদিকে দীর্ঘ দুশো বছরের ইংরেজ রাজত্বের ফল স্বরূপ বহুভাষা ও জনজাতির এই মহান ভারতবর্ষে ভারতীয় ও ইংরেজদের সংমিশ্রণে আত্মপ্রকাশ করেছে এক নতুন জনজাতি, যাদের আমরা বলি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান(Anglo indian)। এরা শিক্ষিত, ইংরাজিভাষী। বিভিন্ন সরকারি কাজে ও রেলের বিভিন্ন দফতরে এদের কদর প্রচুর। এরা নিজেদের ভারতীয় নয় বরং ইংরেজ ভাবতেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু সমস্যা হল, খাঁটি ইংরেজ অর্থাৎ সাদা চামড়ার লোকজনেরা এদের পুরোপুরি নিজের লোক বলে মনে করে না আর এদেশের সাধারণ গরিব-গুর্বো দের কাছেও এরা সন্দেহজনক, বাইরের লোক। ফলে সারা দেশের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এক মারাত্মক আইডেন্টিটি ক্রাইসিস দেখা দেয়। কিন্তু এই সময় অ্যাংলো সাহেবদের চাকুরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে অ্যাংলো সাহেবদের সংখ্যা বেশ সারা দেশে। তারা সবাই ঠিক করল যে এক এক করে সবাই ব্রিটেনে চলে যাবে। ব্রিটেনের মহারানির বিশাল সাম্রাজ্য। সারা পৃথিবী থেকে যদি সব অ্যাংলো সাহেবরাই ব্রিটেনে যেতে চায় তাহলে তো মহা মুশকিল। কিছু লোক ফাঁক ফোকর গলে চলেও গিয়েছিল। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হওয়ায় সে দেশে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। কোথায় যাওয়া যায় ভেবে ভেবে দিন গোনে তারা। এই রকম সময়ে ১৯৩৩ সালে কলকাতা নিবাসী জমি-বাড়ীর কারবারি আর্নেস্ট টিমোথি ম্যাকলাস্কি (E. T. McCluskie) সারাদেশের সমস্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার জন্য স্থাপন করেন কলোনাইজেশান সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (Colonisation Society of India)। এরা রাতুর মহারাজের কাছ থেকে রাঁচির ৬০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে জঙ্গলে ঢাকা ছোটনাগপুর মালভূমির ১০,০০০ একর জমি লিজ নিয়ে গড়ে তোলেন ভারতবর্ষে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের এক নিজস্ব ‘হোমল্যান্ড’ ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ম্যাকলাস্কিতে এসে থাকবার অনুরোধ করা হল।

আরও পড়ুন
তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার

ইরশাদের গাড়ি এসে থামলো রানা কটেজের গেটে। রানা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই জন্মগতভাবে নেপালের রাজপরিবারের মানুষ, কিন্তু প্রায় এক পুরুষ তাঁদের বাস এখানে। রানা সাহেবের বাবা নিজে মিলিটারিতে মেজর ছিলেন। এখানে পোস্টিং ছিল। এখানেই থেকে গেছেন ভালোবেসে। দুপুরে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল আন্টির সঙ্গে। ভাঙাচোরা বাংলাতে বলছিলেন সাধের গঞ্জের গল্প। তাঁর শাশুড়ির কাছে শোনা এ এক মায়াবি গ্রামের গল্প। সারা বছরই বেশ মনোরম আবহাওয়া। শীতকালে প্রচণ্ড শীত হলেও গরমকাল সহনীয়৷ বাতাসের আর্দ্রতা কম। লোকমুখে এই গঞ্জের নাম ছড়িয়ে পড়ল, ‘মিনি ইংল্যান্ড’ বলে। চিঠি পাঠানো হল সারা ভারতের দু-লক্ষ অ্যাংলো পরিবারে। প্রায় তিন চারশো সম্পন্ন অ্যাংলো পরিবার তৎক্ষণাৎ কলোনাইজেশান সোসাইটির শেয়ার কিনে চলে এলেন নদী-পাহাড়-জঙ্গলে ঢাকা মোহময় এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জে। এখানকার আদিবাসী মুন্ডা, ওঁরাও উপজাতির সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে তুললেন বসতি। জঙ্গলের মধ্যে গড়ে উঠল প্রচুর বাংলো। সেখানে এসে সাত-পাঁচ না ভেবেই তারা থাকতে শুরু করল। বাংলোর চারিদিকে বিশাল জায়গা আর তাতে নানান ফলের গাছ লাগল। প্রথমে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে একটু ঝামেলা শুরু হল। তবে অ্যাংলো সাহেবদের দাপটের কাছে তারা হার স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত। তাদের এলাকায় স্থানীয়দের যাওয়ার অনুমতি নাকি ছিল না। অ্যাংলো সাহেবরা নাকি সেই সময় ঘোড়ায় চেপে কাঁধে বন্দুক নিয়ে এক বাংলো থেকে অন্য বাংলোয় যাতায়াত করত। আস্তে আস্তে রেলের স্টেশন হল। দোকানপাট বাজারহাট গড়ে উঠল। চারপাশ জঙ্গলে ঢাকা থাকায় বাঘ-ভাল্লুক-শেয়াল প্রভৃতি বন্য জন্তুর যথেষ্ট উপদ্রব ছিল। সেসব উপেক্ষা করে সকালবেলা কোট-প্যান্ট-হ্যাট পড়া অ্যাংলো সাহেবরা নিজেদের মতো কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকতেন স্টেশন চত্বরে। স্টেশনের বাইরে ফল বিক্রি করত ছোট্ট খুকি কিটি টেক্সিয়েরা। কাঁচা-পাকা রাস্তায় ছুটত ফিটন গাড়ি। নতুন মডেলের অস্টিন, রোলস রয়েস। শনিবার সকালে চার্চের মাঠে জমে উঠত ভিড়। কার্নি মেমসাহেবের লোক মাথায় কালো বাক্স নিয়ে ফেরি করত কেক, প্যাস্ট্রি, কুকিজ। কোনো এক কুয়াশা ঘেরা শীতের বিকেলে রেল লাইনের ওপারের বেরিয়াল গ্রাউন্ডে অকাল প্রয়াত পল স্যন্ডার্সের সমাধির পাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভিজে চোখে বসে থাকত তার বাগদত্তা মিস্ মেরি ম্যাগুইরা। আবছা অন্ধকার নামলে ক্র্যাচ বগলে লাইন পেরিয়ে বাড়ি ফিরত ‘খোঁড়া’ প্যাট। ক্রিসমাস আর নতুন বছরে সেজে উঠত ‘মিনি ইংল্যান্ড’ ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। ডিসেম্বরের প্রচণ্ড শীতের সন্ধায়, রাস্তার দু-ধারের বাংলো বাড়িগুলো ঝলমল করত হ্যাজাকের আলোয়। আড্ডা জমত ফায়ার প্লেসের ধারে। ঝলসানো দিশি মুরগির মাংস, বিলিতি ওয়াইন আর ফরাসি শ্যাম্পেন। গ্রামাফোন রেকর্ডের সুরে বল নাচের আসর বসাত যুবক যুবতীরা। স্ট্যানলি অসওয়াল্ড পটার সাহেবের বাড়িতে গল্পের আসরে হাজিরা দিত ছোটরা। কর্নেল ম্যাকফার্সন তার প্রিয় লাইব্রেরিতে বসে রবিনসন ক্রুসোর পাতা ওল্টাতেন আর ক্লেটন সাহেবের বাড়ির পিয়ানোয় বিঠোভেনের ‘মুনলাইট সোনাটা’ বাজত অনেক রাত পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
কলকাতার নাম বদলে হল ‘আলিনগর’, ইংরেজদের শহর থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন সিরাজ

এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ১৯৩৪ সালে ম্যাকলাস্কি সাহেবের মৃত্যুর পর কলোনাইজেশান সোসাইটের কাজকর্মে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কেউ কেউ শেয়ারে টাকা পয়সা খুইয়ে গঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। এই সময়ে এখানে সব চেয়ে বড় যে সমস্যা দেখা দিল তা হল কাজের অভাব৷ ম্যাকলাস্কি সাহেব এই গঞ্জকে কৃষি নির্ভর এক আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা মতোই প্রতিটি অ্যাংলো পরিবারকে এক থেকে একশো একর পর্যন্ত জমি দেওয়া হয়েছিল বাসস্থান বা খামারবাড়ি করার জন্য। প্রতিটি বাংলো সংলগ্ন জমিতে গড়ে উঠছিল গোলাপ, সূর্যমুখী, টিউলিপ বা অন্যান্য বাহারি ফুল বা ফলের বাগান। আর সেই ফুল-ফল বিক্রি করে বেশ কিছু আয়ও হচ্ছিল। কিন্তু এই অ্যাংলো সাহেবরা ছিলেন মূলত কর্মবিমুখ। ফলে চাষ-আবাদ বা কায়িক শ্রমের কোন কাজ করতে তারা বিশেষ রাজি ছিলেন না। এবং সেই সমস্ত কাজ নিজেরা করলে তাদের আর সাহেবি কদর থাকবেনা ভেবেও ভয় পেতেন তারা। ফলত যা হওয়ার তাই হল। অনেকেরই অবস্থা পড়তে শুরু করল। এর মধ্যেই ১৯৩৯-এ গোটা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। ১৯৪২-এ গান্ধীজির নেতৃত্বে এদেশে শুরু হলো ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। ৪৩-এ নেতাজি তার আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে সরাসরি আঘাত হানলেন ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের বুকে। দেখতে দেখতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এল ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট।

সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত অ্যাংলোদের এ দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা ইংল্যান্ড চলে যাওয়ার যে ট্র্যাডিশান শুরু হয়েছিল তা সমানে চলল প্রায় ৮০-র দশক পর্যন্ত৷ ফাঁকা হয়ে গেল জমজমাট ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। দেশ ছাড়ার আগে অ্যাংলো সাহেবরা তাদের সাধের বাংলো, জমি-বাড়ি সব জলের দরে বেচে দিতে বাধ্য হলেন স্থানীয়দের। তবে কিছু বয়স্করা থেকে গেলেন। কিছু বাংলো আমাদের কলকাতার বাবুরা কিনে ছিল একসময়। যদিও কেউই শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারেননি। আজও বিশাল বিশাল বাংলো গুলো পরে আছে জীর্ণ অবস্থায়। বাংলোর জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতাম পুরনো আসবাবপত্র শুধু রয়েছে। কারণ অবশ্য ছিল। বেড়ে উঠছিল মাফিয়ারাজ। মাথা চাড়া দিল মাওবাদী সমস্যা। আস্তে আস্তে বাঙালি চেঞ্জার বাবুরাও মুখ ফেরাল ম্যাকলাস্কি থেকে। জঙ্গলের মাঝে ফাঁকা বাংলোগুলোর তালা ভেঙে, কড়ি-বড়গা, জানলা দরজা, মূল্যবান যা যা পাওয়া যায় সব লুঠ হয়ে গেল। যাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই এইরকম গোটা কুড়ি অ্যাংলো পরিবার শুধু রয়ে গেল তাদের ‘বিলিতি রূপকথা’ ম্যাকলাস্কিগঞ্জকে আঁকড়ে ধরে। তারা অর্থনীতির কথা চিন্তা করেনি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চারশো পরিবার হারিয়ে গেল ইতিহাস থেকে। রেল লাইনের পাশেই রয়েছে একটা কবরখানা। সেখানে আজও শুয়ে আছে কত অ্যাংলো সাহেব ও মেম সাহেবরা।

আরও পড়ুন
ইংরেজদের সমালোচনা করে নিবন্ধ লিখলেন প্রফুল্লচন্দ্র, চিঠি পেলেন ব্রিটিশ সাংসদের

Powered by Froala Editor