পুলিশের হাতে প্রহৃত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নীরব পিতা প্রমথনাথ

দুই ভাই ছিল একেবারে হরিহর আত্মা। সেই ছোটোবেলা থেকেই। মেজদা যা করবেন, সেটাই করতে হবে তাঁকে। নাহলেই জুড়ে দিতেন প্রবল কান্না। সেবার হাতেখড়ি হবে মেজদা শেখরনাথের। আর তারপরই শুরু হবে স্কুলজীবন। দাদা স্কুলে যাবে, আর তিনি বাড়িতে বসে থাকবেন? হতেই পারে না। একে অপরকে ছেড়ে যে কিছুতেই থাকতে পারেন না তাঁরা। ব্যাস, প্রবল জেদ ধরে বসে রইলেন তিনি। হাতেখড়ি দিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে তাঁকেও। বাবা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তখন কাজ করতেন পুলিশে। কিছুটা বিরক্ত হয়েই শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন তিনি, “এখন স্কুলে যাবার জন্য কাঁদছিস, পরে না যাবার জন্য কাঁদবি। দাও গোপালের সঙ্গে নারুরও হাতেখড়ি।”

নারু অর্থাৎ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (Narayan Gangopadhyay)। সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সমালোচক সব দিকে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রতিভার চিত্র। টেনিদার স্রষ্টা হিসেবে তো বটেই, ছোটোগল্পের জগতেও এক কিংবদন্তি নাম। শৈশব কেটেছে অবিভক্ত ভারতের দিনাজপুরে। প্যালারামের মতোই আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়াতে। রোগে ভুগে পেটে এক মস্ত পিলে। শিঙি মাছের ঝোল খেতেন কিনা বলা যায় না, তবে শীর্ণ চেহারার জন্য বাড়ির লোকের সবসময় দুশ্চিন্তা ছিল তাঁকে নিয়ে। একে বাড়ির ছোটো ছেলে, তার উপর ম্যালেরিয়ার অসুখ। দাদার সঙ্গে হাতেখড়ি দেওয়ার মতো অনেক দাবিদাওয়া পূরণ হয়ে যেত এই দুয়ের জোরে। 

তো সেই ম্যালেরিয়া পালাল কী করে? টেনিদার হাতের রদ্দা খেয়ে নয়, বরং বেলুড় মঠের শান্ত-শীতল পরিবেশে সুস্থ হয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। উত্তরবঙ্গে থাকাকালীন এতবার অসুস্থ হয়ে পড়তেন যে, পরিবারের সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর বেঁচে থাকার। শেষে অনেক ভাবনাচিন্তা করে নিয়ে আসা হল বেলুড়মঠে। শিবানন্দ স্বামীজি স্নেহস্পর্শ, গঙ্গাতীরের স্নিগ্ধ বাতাস আর মঠের শৃঙ্খলিত জীবনযাপনে যেন পুনর্জন্ম হল তাঁর। হাতের লেখা ভালো হওয়ায় বিভিন্ন চিঠিপত্রের উত্তর লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। শিবানন্দ স্বামীজি ডাকতেন ‘বাচ্চা সন্ন্যাসী’ বলে। চিঠি লেখার কাজ শেষ হলে দু-পকেট ভর্তি করে দিতেন ফেনি বাতাসায়। সেটাই ছিল পুরস্কার। কিন্তু কিশোর নারায়ণ উত্তরবঙ্গে ফিরেছিলেন আরো বড়ো এক পুরষ্কার নিয়ে। সুন্দর স্বাস্থ্যের সঙ্গে পেয়েছিলেন দীক্ষা— জীবনের ও মানব-আদর্শের।

ফিরে এসে নিস্তরঙ্গ নিরালায় শুরু হল সাহিত্যচর্চা। বাড়িভর্তি বালক-বালিকার দাপটের মধ্যেও কিছুটা বিচ্ছিন্ন তিনি। মা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর অকালমৃত্যু প্রবলভাবে একা করে দিয়ে গেছে তাঁকে। আকাশে লাল সূর্য ওঠার আগেই, ওই রঙের একটি টিপ কপালে পরে মা কাজে লেগে পড়তেন সারাদিনের জন্য। ছায়ার মতো নিঃশব্দে সমস্ত কাজ সেরে যখন ফিরতেন সন্তানদের কাছে, তখন তারা ঘুমিয়ে কাদা। অসীম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতেন কপালে। সংসারের যাঁতাকলে এইটুকুই দেওয়ার ছিল তাঁর। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন, “মা যে বাড়িতে আছেন, সেটা প্রথম অনুভব করলাম যখন মা হঠাৎ চলে গেলেন চিরদিনের মতো।” ছোড়দি আর ঠাকুমার শাসন কোনোভাবেই পূরণ করতে পারেনি সেই শূন্যস্থান।

আরও পড়ুন
ফরাসি সাহিত্যচর্চায় পেয়েছিলেন সম্মান, বাঙালির কাছে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম লোকনাথ ভট্টাচার্য

এদিকে মেজদা শেখরনাথ তখন ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। বাড়িতে আসছে নিষিদ্ধ বই। পুলিশকর্তা পিতা প্রমথনাথ সব জানতেন, তবু পড়াশোনার ক্ষেত্রে কখনও বাধা সৃষ্টি করেননি। তা সে বাজেয়াপ্ত বই হলেও নয়। এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন তিনি। দূর গ্রাম থেকে ডাকাতদল ধরে, বাড়ি ফিরে তাঁর প্রথম প্রশ্ন থাকত নতুন বইগুলোর ‘ভি-পি’ এসেছে কিনা? বাড়িতে ছিল একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, বাংলার সমস্ত সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকা নিয়মিত আসত বাড়িতে। একদিন সকালে আচমকা বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। “বাঘের ঘরে যোগের বাসা”। খোদ পুলিশের বাড়িতে মিলতে পারে নিষিদ্ধ বই। ভাই-বোনেদের বুদ্ধিতে সেদিন অবশ্য খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাদের। তবু, নিয়ে যাওয়া হল থানায়। রোদে দাঁড় করিয়ে করা হল বেদম প্রহার। প্রমথনাথ তখন থানার ঘরে বসেছিলেন পিছন করে। একটা কথাও বলেননি তিনি। ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য করেননি কোনো অনুরোধ। মার খেয়ে জ্বর চলে আসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। পরে ঠাকুমার তীব্র ভর্ৎসনার মুখে শুধু বলেছিলেন, “অন্যের ছেলেদের যখন এমনি করে থানায় এনে পিটাই; তখন?—”

আরও পড়ুন
নিজে গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র, টেনিদা’কে টানা সাত বছর ফেল করালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

পরে জীবন বয়ে গেছে অন্যখাতে। কলকাতায় পড়তে এসে দুই ভাইই যুক্ত হন যুগান্তর দলের কাজে। কিছু বছরের মধ্যে একাধিকবার গ্রেপ্তার হন শেখরনাথ। ভাইয়ের নিরাপত্তার ভেবেই তৈরি করেন দূরত্ব। অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে মিশে থাকলেও অধ্যাপনা আর সাহিত্যরচনাতেই প্রকৃত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটেছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। ছোটোবেলার স্মৃতি, ম্যালেরিয়া, মায়ের মৃত্যুসহ পারিবারিক আঘাত, পিতার কর্মত্যাগ আর কলকাতার জীবন—সব নিয়েই তৈরি হয়েছিল তাঁর সাহিত্যিক সত্তা। প্যালা হোক, কিংবা ‘কমন-ম্যান’ সুনন্দ, নিবিড়ভাবে তারা জড়িয়ে ছিল আপন চরিত্রের সঙ্গে। 

ঋণস্বীকার : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমগ্র কিশোর সাহিত্য, আনন্দ

Powered by Froala Editor