‘একটি নিখুঁত হত্যাকাণ্ড’ এবং সাহিত্যিক আর্থার আপফিল্ড

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরার পর অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক আর্থার আপফিল্ড (Arthur Upfield) পড়লেন মহাসমস্যায়। যুদ্ধের সময় হাতে বন্দুক তুললেও কলমই তাঁর আসল শক্তি। শরীরে অস্ট্রেলিয়ার আদি উপজাতিদের রক্ত থাকায় কিছুটা বোহেমিয়ান ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। অথচ এক সন্তানের পিতা হওয়ার দায়িত্বও কম নয়। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেন কাজের সূত্রে। একটা সময় ঠিক করলেন, আর নয়! কাজ যেমন চলে চলুক, মনপ্রাণ ঢেলে দেবেন সাহিত্যরচনায়। তখন তিনি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মার্চিসন নামের একটি জায়গায়। খরগোশের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ লোহার বেড়ার দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। পাশাপাশি বুনে চলেছেন গোয়েন্দাকাহিনির রহস্যঘন জাল। আর এই রচনার সুবাদেই তিনি জড়িয়ে গেলেন মার্চিসনের এক ‘নিখুঁত হত্যাকাণ্ড’-এর (Murchison Murders) সঙ্গে।

সেটা ১৯২৯ সাল। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি উপন্যাস। যার মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছে ‘দ্য ব্যারাকি মিস্ট্রি’। মূল চরিত্র ইনস্পেক্টর নেপোলিয়ন ‘বনি’ বোনাপার্টের নাম তখন লোকের মুখে মুখে। তৃতীয়টির কাজ শেষ করে, হাত দিলেন চতুর্থ উপন্যাসে। ভাবলেন এমন একটা হত্যারহস্য তৈরি করা যাক, যা দুনিয়ায় কেউ কখনও দেখেনি। একেবারে নিখুঁত হবে সেই হত্যাকাণ্ড। দেখতে মনে হবে সাদামাটা, কিন্তু ভিতরে থাকবে গোলকধাঁধা। যেখানে কেউ কোনোদিন মৃতদেহকেই খুঁজে পাবে না। আচ্ছা, পুড়িয়ে দিলে কেমন হয়? না, ছাই তো থেকেই যাবে। অ্যাসিড দিয়ে নষ্ট করে দিলে? উঁহু, দামি অ্যাসিড দিলে ব্যাপারটা ‘সাদামাটা’ থাকে না। মাটিতে পুঁতে দিলেও রেহাই নেই। তাতে তো নিশ্চিহ্ন হচ্ছে না দেহ, আজ না হোক কাল খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। ফলে যাই ভাবেন না কেন, খুঁত থেকে যায় তাতেই।

শেষমেষ শরণাপন্ন হলেন বন্ধু জর্জ রিচির (George Ritchie)। বেশ আমুদে এই ভদ্রলোক, প্রথমে তো ভেবে বসলেন আর্থার হয়তো সত্যিই এমন কিছু পরিকল্পনা করছেন। আর তারপর দিলেন এক জব্বর বুদ্ধি। দেহটি কোনো মৃতপশুর সঙ্গে পুড়িয়ে দাও, বাকি হাড়গোড় গুঁড়ো করে ভাসিয়ে দাও হাওয়ায়। সঙ্গে ধাতব কিছু থাকলে কোনো পরিত্যক্ত কুয়োয় ফেলে দেওয়াই যায়। একেবারে ‘নিখুঁত পরিকল্পনা। কিন্তু আর্থারের মনে হল এ যেন একটু বেশিই নিখুঁত। বনির পক্ষেও অসম্ভব হবে এই রহস্যের কিনারা করা। একটা ফাঁকির ফাঁদে আটকে রইল উপন্যাস।

একদিন রিচি কথায় কথায় কাছের রেলস্টেশনের যুবক ‘স্টকম্যান’ রাউলেসকে (Rowles) বললেন আর্থারের সমস্যার কথা। স্টকম্যান মানে রেলচত্বরের গরু-বাছুর দেখভাল করা আর গুনে গুনে তাদের রেলে তুলে দেওয়া। আশেপাশের লোকজন অবশ্য রাউলেসকে ডাকে ‘স্নোয়ি’ বলে, ওই একমাথা সোনালি চুলের জন্য। একদিন তিনজনে মিলে আড্ডাও হল অনেকক্ষণ। ক্রমে আর্থারের পরিচিতি বাড়ে রাউলেসের সঙ্গে। এমনকি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার একটি ছবিও তুলে দেন আর্থার। 

আরও পড়ুন
‘ডাইনি’ সন্দেহে বহু মানুষকে হত্যা, কুসংস্কার নাকি রাজনৈতিক স্বার্থ?

তার কয়েকমাস পরের কথা। জেমস রায়ান ও জর্জ লয়েড নামের দুই ব্যক্তির সঙ্গে রাউলেসকে দেখা গেল ওই স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে। সামান্য ঘটনা, কে আর মনে রাখে? কিন্তু সপ্তাহ খানেক বাদেই আর্থারের কাছে বেশ উত্তেজনা নিয়ে হাজির রিচি। পুলিশ অফিসার জেমস ইয়েটস নাকি পাশের এক শহরে রাউলেসকে দেখেছেন গাড়ি চালাতে। সঙ্গে রায়ান বা লয়েড কেউই ছিল না। আরো এক সপ্তাহ পরে ইউয়ানমি নামের এক ছোটো শহরে আর্থারের সঙ্গে দেখা রাউলেসের। সে পরিষ্কার জানায় যে, রায়ান এখন ম্যাগনেট পাহাড়ে থাকে। আর তার ট্রাকটা রাউলেসকে দিয়ে গেছে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু রায়ান বা লয়েডকে বহুদিন হল চাক্ষুষ দেখেনি কেউই। 

আরও পড়ুন
‘ভূত’ হয়ে নিজেই নিজের হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেন ফিশার সাহেব!

এভাবেই কেটে গেল মাস পাঁচেক। ১৯৩০-র মে মাসে লুইস ক্যারন নামের নিউজিল্যান্ডের এক ভদ্রলোক এসে ওঠেন ইউয়ানমিতে। আলাপ হয় রাউলেসের সঙ্গে। কিছুদিন পর বেপাত্তা হয়ে গেলেন তিনিও। আর তিনজনের মধ্যে একটাই মিল। শেষবার তাঁদের দেখা গেছিল রাউলেসের সঙ্গে। অন্যদিকে গল্পবাজ রিচির সুবাদে পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছিল আর্থারের ‘নিখুঁত হত্যাকাণ্ড’-এর গল্প। প্রশ্ন করা হয় তাঁকেও। সেই সূত্রে তাঁর মনে পড়ে, একদিন ওই জালের ধারে দাঁড়িয়েই গল্প হচ্ছিল এই হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে। সব কিছু কান খুলে শুনেছিল ‘স্নোয়ি’ রাউলেস। অবিলম্বে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর তখনই জানা যায় আরেক ‘নিখুঁত’ কর্মকাণ্ডের।

আসলে ‘রাউলেস’ বলে কেউ নেই, আছে এক জেল পালানো দাগি আসামী। যার নাম জন থমাস স্মিথ। আর্থারের গল্প থেকেই তার মাথায় ঢোকে খুনের বুদ্ধি। তবে কাহিনি থেকে একটা জিনিস বাদ দিয়েছিল সে। আর্থারের গল্পে খুনটাই ছিল আসল আর রাউলেস তো খাঁটি চোর। তাই মৃতদেহের সঙ্গের মালপত্র নষ্ট করেনি সে। ওই একটাই ভুল তার। ক্যারনের সঙ্গে ছিল বিয়ের আংটি। ঘটনাচক্রে সেটি তাঁর হাতের থেকে বড়ো। জুয়েলারি সংস্থাকে বারবার বলেও ঠিক করা যায়নি। আর সেটাই পাওয়া গেল খরখোশের জালের সামনে থেকে। রাউলেসের ঘর থেকেও পাওয়া গেল তিনজনের কিছু সামগ্রী। 

বিচারে তাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগে নাকি সে বলেছিল, “আমি একটি অপরাধে দোষী, তা কোনোদিন ঘটেইনি।” সত্যিই তো, তিনজনের মৃতদেহের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বাকি প্রমাণগুলিও মূলত আর্থার আর রিচির বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে। আর্থার রিচফিল্ডের গোয়েন্দা কাহিনি খুঁজে পায় তার প্লট। আবারও জনপ্রিয় হয় সেই উপন্যাস। এদিকে ১৯৩২-এর ১৩ জুন ফাঁসি দেওয়া হয় ‘মার্চিসন হত্যাকাণ্ড’-এর দোষী রাউলেস ওরফে স্নোয়ি ওরফে জন থমাস স্মিথকে। শুধু নিজের কীর্তির জনপ্রিয়তা টের পেল না সে। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More