‘ডিজনিল্যান্ড’-এর মতো দেখতে কয়েকশো প্রাসাদ, অথচ জনবসতি শূন্য

একটা নয়, দুটো নয়, ৫৮৩টা ডিজনিল্যান্ডের সেই বিখ্যাত প্রাসাদ যেন দাঁড়িয়ে এই শহরে। অনেকে অবশ্য মিল খুঁজে পেতে পারেন ফ্রান্সের ‘শেতৌ’ জাতীয় অট্টালিকার সঙ্গে। কিংবা বলা যেতে পারে দুইয়ের আশ্চর্য মেলবন্ধন। কারা থাকে এখানে? আপাতত কেউ না। আসলে কোনোদিনও কেউ থাকেনি এখানে। সব ঠিকমতো চললে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের আবাস হয়ে উঠতে পারত তুরস্কের (Turkey) এই শহর। যার পোশাকি নাম ‘বুর্জ আল বাবাস’ (Burj Al Babas)। অথচ এখন স্থানীয় কুকুর-বিড়াল ছাড়া কেউ ঘুরেও তাকায় না এর দিকে। ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশো বিলাসবহুল অট্টালিকা।

উত্তর-পশ্চিম তুরস্কের প্রসিদ্ধ অঞ্চল বোলু প্রদেশ। কাছেই রয়েছে কৃষ্ণসাগরের মনোরম সৌন্দর্য। ইস্তানবুল আর রাজধানী আনকারা থেকেও দূরে নয় খুব বেশি। খ্যাতি রয়েছে মুডুর্নু শহরের ঐতিহাসিক মসজিদটিরও। ২০১৪ সালে দুবাইয়ের সংস্থা ‘সারোত গ্রুপ’ তুরস্ক সরকারের কাছে নিয়ে আসে এর পরিকল্পনা। মালিকরা অবশ্য তুরস্কেরই। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা ছিল ২৫০ একর জমিতে তৈরি হবে মোট ৭৩২টি প্রাসাদ। শহরের মাঝখানে গড়ে উঠবে বিরাট শপিং মল, সিনেমা হল-সহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র চালু থাকবে প্রায় সারাদিন। তার সঙ্গে অট্টালিকার নিজস্ব সৌন্দর্যও তো কম নয়। গথিক, ইংরেজ ও আমেরিকার স্থাপত্যকর্মের এক আশ্চর্য মিশ্রণ সেগুলি। ইস্তানবুলের গালাতা টাওয়ারের ছাঁচে তৈরি হবে চূড়ার অংশ। ফ্রান্সের ‘শেতৌ’-র প্রভাব তো লক্ষ করা যায় প্রতিটা পদক্ষেপে। সব মিলিয়ে যেন মধ্যযুগে বাস করার অনুভূতি এনে দেবে বুর্জ আল বাবাস।

শরীর তরতাজা রাখার জন্য মাটির তলার দুশো মিটার গভীরতার পাইপ লাইনের সাহায্যে কৃষ্ণসাগরের উষ্ণপ্রস্রবণ এসে পৌঁছোবে ঘরে ঘরে। একদিকে রয়েছে ঘন সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়। শীতকালে তুষারপাত সাদা চাদর বিছিয়ে দেবে শহরজুড়ে। কে না চায় এরকম রাজার হালে থাকতে? হোক না এক-একটা প্রাসাদের দাম সাড়ে তিনলক্ষ মার্কিন ডলার থেকে সাড়ে পাঁচলক্ষ ডলারের মধ্যে। অর্থ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই আরবের আগ্রহী ধনকুবেরদের।

২০১৪-তে শুরু হয় বুর্জ আল হাবাসের কাজ। বাজেট প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার। ২৫০০ কর্মী খেটে যাচ্ছে উদয়াস্ত। চার বছরের মধ্যে শেষ করতেই হবে পুরো প্রকল্পের কাজ। এমনকি দুবছরের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অট্টালিকার অগ্রিম বিক্রি পর্যন্ত হয়ে যায়। ২০১৯-র মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে যায় ৫৮৩টি প্রাসাদের কাজ, আরো একশোটির কাজ হয়ে রয়েছে অর্ধেকের বেশি। মসৃণ-ঝকঝকে রাস্তাঘাট তৈরি নতুন অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য। আর সেবছরই এক ভয়ানক মন্দার মধ্যে পড়ে গোটা তুরস্কের অর্থনীতি। প্রায় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দেনায় ডুবে দেউলিয়া হয়ে যায় ‘সারোত গ্রুপ’। বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হয় পুরো প্রকল্পের কাজ।

আরও পড়ুন
‘তুলে’ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটা গোটা শহর, কারণটা কী?

সরকার থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল অবশ্য। পাশের শহর মুডুর্নুর মেয়র বেশ জোরের সঙ্গেই দাবি করেছিলেন এই পরিত্যক্ত শহরের সম্মান তারা ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থায় এত বড়ো এক শহরের অনিশ্চিত দায়িত্ব নেওয়া ছিল একপ্রকার ‘সাদা হাতি’ পোষার সামিল। একটা সময়ে পিছু হটে তারাও। ফলে কোটি কোটি টাকার স্বপ্নের প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখনও অথৈ জলে। শুধু পর্যটকদের একবেলার আকর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নেই বুর্জ আল বাবাসে। কিছু সিনেমার চিত্রগ্রহণও হয়েছে এখানে। আবার কি কখনও ফিরে আসতে পারে তার অনাগত গরিমা? কালের গর্ভেই লুকিয়ে তার উত্তর...

আরও পড়ুন
‘কবিতার শহর’ লেইডেন

Powered by Froala Editor