ব্যাট নিয়ে ধর্মান্ধদের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটারের প্রাণ বাঁচান সিকে নাইডু

সকাল ৬টা থেকে চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে সব বাণিজ্যিক ফ্লাইটের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুখোই-৩০ ফাইটার প্লেনের একটু দেরি করেই আকাশ চক্কর। পুলিশ ছাড়াও, শহরের প্রতিটি মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল। মোহালি ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে দেখলে মনে হবে যেন একটি আস্ত সেনানিবাস। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারত পাকিস্তান ম্যাচ (India Pakistan cricket match) ঘিরে পরিস্থিতি ছিল অনেকটা এমনই।

বোঝাই যাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের কথা যখনই আসে, তখন 'মহারণে'র রঙে আঁকা হয় দুই দলের এই মাঠের লড়াইকে। অবশ্যই, দুই দেশের মধ্যে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ক্রিকেটাররাও বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন নিজেদের মধ্যে। তবে মাঠের এই লড়াইয়ের বাইরেও ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সম্পর্কের অসাধারণ রসায়নও দেখা গিয়েছে। আর এই সম্পর্ক চলে আসছে ১৯৪৭ সালের আগে, ভারত ভাগ না হওয়া থেকেই।

স্বাধীনতার আগে, শুধুমাত্র একটি ভারতীয় দল ছিল। তারা আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের হয়ে খেলত। দলে ছিলেন লালা অমরনাথ, সিকে নাইডু, আবদুল হাফিজ কারদার, ফজল মাহমুদ, আমির ইলাহি এবং গুল মহম্মদের মতো ক্রিকেটাররা। আবদুল হাফিজ কারদার, আমির ইলাহি এবং গুল মহম্মদ ভারত ও পাকিস্তান দুই দলের হয়েই খেলেছেন। প্রসঙ্গত, লাহোরের বোলার ফজল মাহমুদের (Fazal Mahmood) কথা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রথম পোস্টারবয়দের অন্যতম।

ভারতীয় দলের ১৯৪৭ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। কানওয়ার রাই সিং, লালা অমরনাথ, ফজল মাহমুদরা তখন পছন্দের তালিকায়। ১৯ বছর বয়সে ফজল মাহমুদ ভারতীয় দলে নির্বাচিত হন। কিন্তু এরপর যা ঘটে, তা ঐতিহাসিক।

আরও পড়ুন
পুরুষ নয়, প্রথম চালু হয়েছিল মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ

ফজল মাহমুদ তাঁর আত্মজীবনী 'ডন টু ডাস্ক'-এ লিখেছেন, 'আমাকে কয়েক মাস আগে বলা হয়েছিল ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট লাহোর থেকে পুণে আসতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমি লাহোরে ছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে দেশভাগ হয়ে গেছে। আমি এমন এক সময়ে লাহোর থেকে পুণে যাচ্ছিলাম, যখন দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত। দাঙ্গায় পুড়ছিল পঞ্জাব। এটা খুবই ভয়ানক যাত্রা ছিল।’

আরও পড়ুন
ভারত-পাকিস্তান দুই দলের হয়ে খেলা তিন ক্রিকেটার

এমন অবস্থায় ভারতীয় ক্রিকেট নির্বাচকরা নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিলেন না। ফজল মাহমুদ আরো লিখছেন, 'অবশেষে ১৯৪৭ সালের ইন্ডিয়া ক্যাম্প ভেঙে গেল। আমার সামনে তো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ, কীভাবে পুণে থেকে লাহোরে বাড়িতে ফিরব। লাহোর তখন পাকিস্তানের। ধর্মীয় দাঙ্গার পরিবেশ। আমি পুণে থেকে ট্রেনে বোম্বে এসেছিলাম। সিকে নাইডুও আমার সঙ্গে ছিলেন। ট্রেনে আমাকে কিছু ধর্মান্ধরা টার্গেট করে। তারা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু সিকে নাইডু আমাকে বাঁচায়। সে তার ব্যাট নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলে।’

কিংবদন্তি সিকে নাইডুই (C. K. Naidu) অবিভক্ত ভারতের প্রথম অধিনায়ক। দেশভাগের পর পাকিস্তান দল প্রথমবার ভারত সফরে আসে ১৯৫২ সালে। সেই সফরে লালা অমরনাথ এবং আবদুল হাফিজ কারদারের মতো অনেক খেলোয়াড় ছিলেন, যাঁরা অবিভক্ত ভারতে একসঙ্গে খেলতেন। লাহোরের মিন্টো পার্কে একসঙ্গে অনুশীলনও করতেন তাঁরা। কথিত আছে, পাকিস্তান দল যখন ভারত আসে লালা অমরনাথ স্বয়ং তাঁদের রিসিভ করতে গিয়েছিলেন। এভাবেই বন্ধুত্বের গল্পও তৈরি হতে থাকে দুই দলের ম্যাচকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে দুই দলের মধ্যে ক্রিকেট সিরিজ বহুদিন বন্ধ। সময়ের সরণি বেয়ে দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেটীয় সম্পর্কের এমন নানান কিসসা কিন্তু আজও প্রাণবন্ত, স্মৃতির পাতায় অমলিন।

Powered by Froala Editor