পুরুষ নয়, প্রথম চালু হয়েছিল মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ

ফের ভারতের মাটিতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ (Cricket World Cup)। দেখতে দেখতে চলে এল ফাইনালের দিন। ২০১১ সালে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সেই রাতের উন্মাদনাটা ফেরার অপেক্ষায় বুক বাঁধছে সমগ্র দেশবাসী। আর এবার তো ক্রিকেট বিশ্বকাপের পঞ্চাশতম বছর। ১৯৭৩ সালের জুন-জুলাই মাসে শুরু হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপের পথচলা। এরকম ঐতিহাসিক বছরে ফের ভারতের হাতে কাপ উঠলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা। 

কী ভাবছেন? তথ্যে ভুল আছে? ১৯৭৫-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ। যেটাতে জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হ্যাঁ, ঠিকই। সেটা তো ছিল পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। কিন্তু তারও দুবছর আগে সাদা জামা, সাদা স্কার্ট পরা, বিনুনি বাঁধা একদল মহিলা যে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম ক্রিকেট ‘বিশ্বকাপ’-এর (Women's Cricket World Cup) স্বাদ এনে দিয়েছিল, সেটা ভুললে তো চলবে না। 

ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭৩ সালের ২০ জুনে। লন্ডনে সেদিন তুমুল বৃষ্টি। ড্রেসিং রুমে অপেক্ষায় জামাইকা আর নিউজিল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেট দল। ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায় স্টেডিয়ামের দর্শকরা। কিন্তু না, পরিত্যক্ত হল বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ। একটা বলও গড়ায়নি সেদিন, এমনকি টস পর্যন্ত হয়নি। এবারের মতো সেবারও ছিল ‘রাউন্ড রবিন’ পর্যায়ের ম্যাচ। অর্থাৎ প্রতিটি দল খেলবে নিজেদের মধ্যে। ৬০ ওভারের ম্যাচে জিতলে চার পয়েন্ট, ড্র হলে এক। শেষ ম্যাচ হবে ২১ জুলাই। খেলার পর লিগ শীর্ষে থাকা দল হবে চ্যাম্পিয়ন। 

মহিলাদের ক্রিকেটদল তখন হাতেগোনা। টেস্ট খেলিয়ে দল হিসেবে ছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। না, ভারতের মহিলা দল ছিল না সেই বিশ্বকাপে। তার কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ডের মহিলা দল টেস্ট খেলতে গেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেখান থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় জামাইকা আর ত্রিনিদাদ-টোবাগোকে। তবে গোল বাঁধে সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট টিমকে নিয়ে। বর্ণবিদ্বেষের জন্য আইসিসি নির্বাসিত করেছে সেই দেশকে। তড়িঘড়ি তৈরি করা হল ‘আন্তর্জাতিক একাদশ’ নামের একটি দল। দক্ষিণ আফ্রিকার পাঁচজন ক্রিকেটারকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হলেও প্রবল আপত্তি জানায় ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের খেলোয়াড়রা। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দেশেরই আরো কিছু খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয় দলটি। তার সঙ্গে মূলত ইংল্যান্ডের ‘অতিরিক্ত’ প্লেয়ারদের নিয়ে অংশগ্রহণ করে ‘নিউ ইংল্যান্ড’ নামের একটি দল। সাত দলে শুরু হয় ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ।

আরও পড়ুন
ভারত-পাকিস্তান দুই দলের হয়ে খেলা তিন ক্রিকেটার

শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি। কিন্তু পরের ম্যাচেই মাত্র ৩১ ওভারে নিউ ইংল্যান্ডকে ৫৭ রানে ‘অল আউট’ করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। টিনা ম্যাকফেরসন একাই নেন পাঁচ উইকেট। মাত্র তিন উইকেট হারিয়ে সেই রান তুলে নেয় তারা। ওই দিনই আরেকটি ম্যাচে আন্তর্জাতিক একাদশের বিরুদ্ধে এক উইকেট হারিয়ে ২৫৮ রান তোলে ইংল্যান্ডের মহিলা খেলোয়াড়রা। বিশ্বকাপে প্রথম শতরানের কৃতিত্ব অর্জন করেন লিন থমাস ও এনিড বেকওয়েল। ম্যাচটি তারা জিতেও নেন অনায়াসে। সমগ্র প্রতিযোগিতাতেই এই নতুন দুটি দল এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দলদুটি একেবারেই সুবিধা করতে পারেনি। মূল লড়াই হয়েছিল ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে।

আরও পড়ুন
নিশীথ সূর্যের দেশে ক্রিকেট

অবশেষে এল বহুপ্রতীক্ষিত সেই দিন। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ চললেও আসলে ২১ জুলাইয়েই ছিল ফাইনাল। ৫ ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট সংগ্রহ করে লিগ শীর্ষে অস্ট্রেলিয়া। যদিও তাদের একটি ম্যাচ বৃষ্টির কারণে ড্র ঘোষিত হয়েছিল। অন্যদিকে সমসংখ্যক ম্যাচে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ১৬ পয়েন্ট। এজবাস্টন ক্রিকেট মাঠে এই ম্যাচ যে জিতবে সেই ‘চ্যাম্পিয়ন’। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। ফের সেঞ্চুরি হাঁকান এনিড বেকওয়েল। জবাবে ৬০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া তোলে ১৮৭ রান। বল হাতেও ২ উইকেট নিয়ে ভেলকি দেখান এনিড। গোটা প্রতিযোগিতায় ২৬৪ রান করে তিনিই সর্বোচ্চ রানশিকারি। ১২টি উইকেট নেন ইংল্যান্ডের রোজালিন্ড হেগস। অধিনায়িকা র‍্যাচেল হেহো ফ্লিন্টের (Rachael Heyhoe Flint) হাতে সুদৃশ্য বিশ্বকাপ ট্রফিটি তুলে দেন ইংল্যান্ডের রাজকন্যা অ্যানি অফ এডিনবরো। 

অবশ্য একজনের কথা এখানে না বললেই নয়। যাঁর নাম ‘স্যার’ জ্যাক আর্নল্ড হেওয়ার্ড (Jack Arnold Heyward)। ব্যবসায়ী হলেও মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে। ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধশালী ফুটবল ক্লাব উলভসের প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি। সেই যে ইংল্যান্ড দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেল, তার খরচ বহন করেছিলেন জ্যাক আর্নল্ড। যা ছিল ক্যারিবিয়ান দলদুটিকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ‘অফিসিয়াল’ সফর। আসলে জ্যাক ও ফ্লিন্টের মধ্যে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছিল তার আগেই। জ্যাক জানতেন মহিলাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের খরচ ইংল্যান্ড বোর্ড ও আইসিসির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই নিজের পকেট থেকে ওই সময়ে ৪০০০০ পাউন্ড ব্যয় করে অনুষ্ঠিত করেন টুর্নামেন্টটি।

সে বছর মাঠে জিতেছিল ইংল্যান্ড আর মাঠের বাইরে জিতেছিল ক্রিকেট। র‍্যাচেল ফ্লিন্ট ছিলেন যার পথপ্রদর্শক। একটা মাস জুড়ে উৎসবের আবহে জড়িয়ে ছিলেন প্রতিটি প্লেয়ার। উদযাপন চলেছিল ক্রিকেটের। তৈরি হয়েছিল অসংখ্য মুহূর্ত আর গল্প। ধবধবে সাদা পোশাকে ইংল্যান্ডের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মাঠে নামছে বাইশ জন ক্রিকেটার। বুলেটের গতিতে বল ছুটে এসে ভেঙে দিচ্ছে উইকেট। কিংবা কবজির আলতো মোচড়ে বল পৌঁছোচ্ছে বাউন্ডারিতে। উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে দর্শক। ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাল দাগে লেখা হচ্ছে ইতিহাস। ১৯৭৮-এ ভারতে মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজন যেন তারই উত্তরসূরি। আর সেই ট্র্যাডিশন বজায় রয়েছে আজও। 

Powered by Froala Editor