‘ডাইনি’ সন্দেহে বহু মানুষকে হত্যা, কুসংস্কার নাকি রাজনৈতিক স্বার্থ?

১৬৯২ সাল। আমেরিকা তখন ইংল্যান্ডের অধীনে। স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের একপ্রকার ‘একঘরে’ করেছে সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশরা। নিজেদের মধ্যেও আছে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ। শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই গ্রামগুলিতে, জীবনযাত্রা কুসংস্কারে পূর্ণ। তারই মধ্যে আচমকা ম্যাসচুটেসের সালেম (Salem) গ্রামে শোনা গেল ‘ডাইনি’-র আবির্ভাবের গল্প। শুরু হল ‘উইচ হান্ট’। রীতিমতো আদালত বসিয়ে আইনসিদ্ধভাবে হত্যা করা হয় বহু নারী-পুরুষকে। কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রহের পাশাপাশি আমেরিকার ইতিহাসের আরো একটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষ্যবহন করে ‘সালেম উইচ ট্রায়াল’-এর (Salem Witch Trial) ঘটনা।

অবশ্য মধ্যযুগের ইউরোপ বা আমেরিকাতে ‘ডাইনি হত্যা’-র মতো বিষয় নতুন কিছু নয়। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিতে প্রাণ গেছে কয়েক হাজার সাধারণ মানুষের। আবার, অনেকেই নিজেকে তন্ত্রমন্ত্র-সিদ্ধ বলেও দাবি করত। অশিক্ষা আর অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে চলত আধিদৈবিক সমস্ত কাজকর্ম। ডাইনি বা ভ্যাম্পায়ারদের গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে পুরোটাই প্রায় অতিরঞ্জিত। অজ্ঞাত অসুখ-বিসুখ, ভিতরকার রাজনীতি, বিদ্বেষ জট পাকিয়ে তৈরি করত এইসব অমানবিক কর্মকাণ্ড।

সালেমের ঘটনাতেও কিন্তু তারই ইঙ্গিত মেলে। ১৬৯২ সালের জানুয়ারি মাসে নয় বছরের বালিকা এলিজাবেথ বেটি প্যারিস ও এগারো বছরের অ্যাবিগেল উইলিয়ামস আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বারবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি, চিৎকার, হিংস্র আচরণ এসব ছিল বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মৃগী রোগীর থেকে হয়তো আলাদা কিছু নয়। স্থানীয় ডাক্তার অবশ্য বিধান দেন, এদের উপর ভর করেছে ‘অতৃপ্ত আত্মা’। যার সঙ্গে যোগসাজশ আছে কোনো ডাইনির। ক-দিন পরে অ্যান পুতনাম, মার্সি লুইজ-সহ কয়েকজন বালিকার মধ্যেও দেখা দিল একই রকম উপসর্গ। ডাক্তারের মহান নিদানের সাফল্য প্রমাণিত হল আরেকবার! এই ‘রোগ’-এর চিকিৎসাও কঠিন নয়। আশেপাশেই লুকিয়ে আছে সেইসব ডাইনিরা। খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দিলেই সুস্থ হয়ে যাবে বালিকারা।

স্থানীয় প্রশাসন ফেব্রুয়ারি মাসেই গ্রেপ্তার করে তিন মহিলাকে। প্রথমজন তিতুবা (Tituba) ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস, বাকি দুজন সারাহ গুড ও সারাহ অসবর্ন পেশায় ভিখারি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই চলল ‘ডাইনি’সুলভ কাজকর্মের বিচার। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল আদালতে। এমনিতে ডাইনিতে ভয় থাকলেও, বিচারের দৃশ্য থেকে বঞ্চিত থাকতে চাইল না কেউই। আশ্চর্যের বিষয়, তিতুবা কিন্তু ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগ অস্বীকার করল না। বার্বাডোসের আদি বাসিন্দা এই বয়স্ক মহিলা বরং রাজসাক্ষীর মতো চাইল অন্য বন্দিদের কর্মকাণ্ড ‘ফাঁস’ করে দিতে। ঘটনাচক্রে তিতুবা ছিল প্যারিস পরিবারেরই ক্রীতদাস। অত্যাচারের বদলা নেওয়ার জন্য সে এই পথ নিয়েছে বলেই লোকে বিশ্বাস করল। জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বুঝে তিতুবাও খুলে বসল তার গল্পের ঝুলি। ‘ভুডু’বিদ্যার কথা, তার দেশের মারণ মন্ত্রের গল্প, আরো হরেক রকম কারসাজির গল্প বলতে শুরু করে সে। একটা সময়ে স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, স্বয়ং শয়তান বসে আছে সালেমে। এই মহিলারা তো নিমিত্তমাত্র।

আরও পড়ুন
ডাইনি অপবাদে মৃতাদের নামে রাস্তার নামকরণ, 'পাপস্খলন' স্পেনের

সম্ভবত, নিজেকে বাঁচানোর জন্য এটাই ছিল তিতুবার পরিকল্পনা। তার মুখে শোনা যায়, আরো কয়েকজন ‘ডাইনি’-র নাম। এদিকে, গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ক্রমশ বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। আতঙ্ক গ্রাস করে গোটা গ্রামকে। বিশ্বাস উঠে যায় মানুষের মধ্যে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে নির্বিচার ধরপাকড়ে পুরুষ-মহিলাসহ জেলবন্দি হয় প্রায় ২০০ জন। বাদ যায়নি চার্চের নান-রাও। এমনকি সারাহ গুডের চার বছরের মেয়েকেও গ্রেপ্তার করা হয় ‘ডাইনি’ অভিযোগে। ২ জুন জন হ্যাথোর্ন, স্যামুয়েল সেওয়াল ও উইলিয়াম স্টোউঘটনের নেতৃত্বে শুরু হয় কুখ্যাত ‘সালেম উইচ ট্রায়াল’। মূল অভিযুক্ত সাব্যস্ত করা হয় ৩০ জনকে। ‘শয়তান’-এর সঙ্গে যোগাযোগ, ডাইনিবিদ্যা, হত্যার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি অভিযোগে ১৯ জনের হয় ফাঁসির আদেশ। তাদের মধ্যে ১৪ জন মহিলা ও ৫ জন পুরুষ। ১০ জুন প্রথম ফাঁসি দেওয়া হয় ব্রিজেট বিশপ (Bridget Bishop) নামের এক মহিলাকে। জেলের ভিতরের অত্যাচারে মারা যায় গিলস কোর নামের এক ব্যক্তিসহ পাঁচজন। ১৬৯৩-র মাঝামাঝি পর্যন্ত এই নিয়ে সরগরম থাকে সালেম। তারপর থিতু হয়ে যায় সবকিছু।

আরও পড়ুন
বৌদ্ধ তন্ত্রযানের দেবী কঙ্কই কি পরবর্তীকালের জগদ্ধাত্রী?

পরে অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পারে ম্যাসাচুটেস কর্তৃপক্ষ। তুলে নেওয়া হয় সমস্ত অভিযোগ, ক্ষমাও চেয়ে নেন তারা। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় প্রত্যেককে। ১৬৯৭-এ সালেমের ঘটনার প্রায়শ্চিত্তে পালন করা হয় শোকদিবস। তারপরেও কিন্তু থেকে একটা জটিল প্রশ্ন। নিছক ‘ভুল’ করেই কি চলেছিল ডাইনিহত্যা? নাকি পুরো বিষয়ের পিছনে কাজ করেছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য? দেখা যাক একবার।

প্রথম ‘আক্রান্ত’ এলিজাবেথের বাবা স্যামুয়েল ছিলেন গ্রামের মন্ত্রীস্থানীয়। চার্চেও ক্ষমতা ছিল তাঁর। কৃষ্ণাঙ্গ তিতুবা ছিল তাঁর ক্রীতদাস। কয়েকদিন পরে আক্রান্ত অ্যান পুতনামের পরিবারও ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। অন্যদিকে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন কৃষিজীবী এবং ধর্মীয় জীবনে ‘পিউরিটান’। ‘উইচ ট্রায়াল’-এর তিন বছর আগেই আমেরিকার কলোনিগুলি নিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একপ্রস্ত যুদ্ধ হয়েছে ফ্রান্সের। গ্রামেও এসে পড়েছে তার আঁচ। আবার স্থানীয় রেড-ইন্ডিয়ান বা কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরাও যে খুব শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছে তাও নয়। ধিকিধিক আগুন জ্বলছে চারদিকেই। সব মিলিয়ে উচ্চবংশীয়দের মধ্যে কপালে কিন্তু চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। বাকি কাজটা করে দিয়েছিল গ্রামের মানুষের অশিক্ষা আর কুসংস্কার। পরবর্তী গবেষণাতেও গুরুত্ব পেয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক এই দিকগুলি। ‘ভুয়ো’ খবর আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিচারের নামে প্রহসন বিষয়টির চেহারা বোধহয় বিশ্বের সবদেশে, সবকালে একইরকম। 

Powered by Froala Editor